আর একবার দম নিতে উঠে ফের ডুব দিতেই করালীবাবু এক্কেবারে মুখোমুখি দেখেন, এক বিকট মূর্তি বিশাল পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিকট দাঁত দেখিয়ে হাসছেও। করালীবাবু জ্যাভেলিন বাগিয়ে ধরে মনে-মনে আর একটা ইকোয়েশন করবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভয়ে কিছু মনেই পড়ল না। বিকট মূর্তিটা জ্যাভেলিন বাগানো দেখেও ভয় খায়নি, হাত-পা ছড়িয়ে হাসছে। কিন্তু একটুও নড়েনি। করালীবাবু সাহস পেয়ে আর-একটু কাছে এগিয়ে দেখেন, ও হরি! এ যে সদ্য বিসর্জন-দেওয়া একটা কালীমূর্তি! এখনো কাঠামো থেকে মাটি বা রঙ খসেনি ভাল করে।
তিন নম্বর শ্বাস নিয়ে দম ধরে করালীবাবু দক্ষিণের ঘাট বরাবর পৌঁছে খুব সন্তর্পণে যেই আর-একবার শ্বাস নেওয়ার জন্য মাথা তুলেছেন অমনি খুব কাছেই বাজ-ডাকার মতো বাঘ ডাকল ‘ঘ্রা-ড়া-ড়া-ম্-ম্?”
সেই ডাকে খানিকটা অবশ হয়ে গিয়ে ডুব দিতে ভুলেই গেলেন করালীবাবু। খোলামেলা ঘাটের কাছে, জ্যোৎস্নায় বোকার মতো মাথা উঁচু করে রয়েছেন। হঠাৎ ঘাটের পৈঠায় এক বিশাল চেহারার মানুষের ছায়া দেখা গেল। লোকটা হুংকার দিয়ে বলে উঠল, “কে রে?”
করালীবাবু টুপ করে ডুব দিলেন। আসলে নিজের ইচ্ছেয় যে ডুব দিলেন তা নয়, মনে হল কে যেন তার ঠ্যাং ধরে জলের নীচে টেনে নিয়ে ছেড়ে দিল। ভাগ্যিস টানল! নইলে তাঁর শরীর এমন আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ডুব দেওয়ারও ক্ষমতা ছিল না।
জলের নীচে ছয় নম্বর ডুবো সিঁড়িটা খুঁজতে আরও কিছু সময় লাগত। কিন্তু মজা হল, করালীবাবু ডুববার সঙ্গে-সঙ্গে কে যেন তাঁর হাতের জ্যাভেলিনটা ধরে খুব আস্তে তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়ে একটা ফাটলের মুখে ছেড়ে দিল।
কী হচ্ছে, ধরা পড়ে গেছেন কিনা, তা বুঝতে পারছিলেন না করালীবাবু। কিন্তু ভাববার সময় নেই। মনে মনে একটা সহজ ফ্যাক্টর কষে নিয়ে সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে কয়েক কদম হাঁটতেই একটা পথ পেলেন : এখানে জল কোমর-সমান। পথটা উঁচু হয়ে উঠে গেছে, ঘোর অন্ধকারেও হাতড়ে-হাতড়ে বুঝলেন।
খুব দূর থেকে একটা সোরগোলের আওয়াজ আসছে। ওরা কি তবে টের পেল?
সময় নেই। করালীবাবু জ্যাভেলিন হাতে অন্ধকারে পথটা বেয়ে উঠে গেলেন। নিখাদ অন্ধকার একটা সুড়ঙ্গ। পদে পদে নুড়ি পাথর, শ্যাওলা, ঘুমন্ত ব্যাঙ পায়ের নীচে টের পাচ্ছেন। একটা সাপকেও কি মাড়ালেন? কে জানে! তবে করালীবাবু এগিয়ে গেলেন ঠিকই। অন্ধকারে ক্যালকুলেশন চলে না বলে বারকয়েক আছাড়ও খেলেন। তবু এগোলেন। বেশি দূর যেতে হল না। পাঁচ-নম্বর আছাড়ের পর সোজা গিয়ে একটা দরজায় সজোরে ধাক্কা খেয়ে “বাবা রে” বলে বসে পড়লেন।
কিন্তু বিশ্রামের সময় নেই। হাতড়ে দেখেন দরজার গায়ে পুরনো তালা ঝুলছে। এক মুহূর্ত চিন্তা না করে জ্যাভেলিনের ফলাটা তালার ভিতরে ঢুকিয়ে চাড় দিতেই মরচে-ধরা তালা হড়াক করে খুলে গেল।
ঘরের ভিতর কোনও আলো ছিল না, তবে অনেক ওপরের একটা বড় ঘুলঘুলি দিয়ে পুরো চাঁদটা দেখা যাচ্ছে। আর চাঁদটা ঠিক টর্চের মতো ফোকাস ফেলেছে সোজা বুরুনের মুখের ওপর। করালীবাবু দেখেন, একটা চটের বিছানায় পাশাপাশি বুরুন আর ভুতুম শুয়ে ঘুমোচ্ছে। খুব শান্ত মুখ, মুখে একটু হাসি, তবে আবছা আলোতেও বোঝা যায়, ওরা খুব দুর্বল। একটুও নাড়াচাড়া বুঝি সইবে না। দু’দিনেই রোগা হয়ে গেছে ছেলে দুটো।
বুরুনকে একটা কথা বলতে হবে। রাম কবিরাজ কথাটা বারবার শিখিয়ে দিয়েছেন করালীবাবুকে। কিন্তু কথাটা এতই সামান্য, এতই ছেলেমানুষী যে, সে কথাটা বুরুনকে বলার কোনও মানেই হয় না। অথচ রামবাবু বারবার তাঁকে বলে দিয়েছেন যে, এই বাক্যটা নাকি বুরুনের পক্ষে মন্ত্রের মতো কাজ করবে। কবিরাজমশাই বিচক্ষণ মানুষ। তাঁর ওপরে কথাও চলে না।
কথাটা বলার জন্য করালীবাবু আস্তে আস্তে বুরুনের শিয়রের কাছে এগিয়ে গেলেন। হাঁটু গেড়ে বসলেন। খুবই সোজা কথা। কবিরাজমশাই বলে দিয়েছেন, একটু চেঁচিয়ে নামতার সুরে কথাটা বার কয়েক আওড়াতে হবে। কবিরাজমশাই বারবার জিগ্যেস করেছিলেন, “কথাটা মনে থাকবে তো কালীবাবু? ভুলে যাবেন না তো? যতই সামান্য শোনাক, এ-কথাটা কিন্তু বুরুনের বেঁচে থাকার পক্ষে খুব জরুরি।”
ফুঁ! তখন হেসেছিলেন করালীবাবু। এর চেয়ে কত শক্ত শক্ত কথা তার মনে থাকে। আর এ তো কোনও কথাই নয়। জলের মতো সোজা একটা বাক্য। নামতার সুরে বলতে হবে।
ঘরের বাইরে হঠাৎ খুব কাছেই আবার ‘ঘ্রা-ড়া-ড়া-ড়া-হু-উ-ম’ করে ডাক শোনা গেল, আর একটা ধীর ভারী পায়ের শব্দ এগিয়ে আসতে লাগল।
সময় নেই, করালীবাবু বুরুনের কানের কাছে মুখ নিয়ে খুব চেঁচিয়ে কথাটা বলতে গিয়েই বিস্ময়ে থ’ হয়ে গেলেন। কথাটা তাঁর একদম মনে নেই! বেমালুম ভুলে গেছেন।
‘ঘ্রা-ড়া-ড়া-ড়া-ড়া–হু-উ-ম! আবার ডাকল বাঘটা। এবার খুব কাছেই। পায়ের শব্দটাও এগিয়ে আসে ধীরে ধীরে।
করালীবাবু নিজের মাথার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলছেন রাগে। কথাটা কিছুতেই মনে পড়ছে না যে…হ্যাঁ হ্যাঁ, একটা শব্দ ছিল…অঙ্ক…আর একটা যে কী যেন…তেরো…তেরো…হ্যাঁ…।
ওদিকে আর একটা দরজা। সেই দরজার লোহার হুড়কো খোলার শব্দ হচ্ছে।
করালীবাবুর হাতের খামচায় একগোছা চুল তাঁর মাথা থেকে উপড়ে এল। …তেরো..তেরো..তেরো… নামতার সুরে… বুরুন…বুরুন…বুরুন…