আবেগে করালীবাবুর চোখে জল এল। রাগে তাঁর গা ফুলতে লাগল। আপনমনে তিনি বললেন, “বাঘটাকে নিকেশ করতেই হবে।”
গেম টিচার পাশেই বসে ছিলেন। করালীবাবুর কথাটা তাঁর কানে যেতেই তিনিও চোখ মুছে ধরা গলায় বললেন, “বুরুনের ওপর আমার অনেক আশা ছিল। অলিম্পিক থেকে তার অন্তত
দশ বারোটা সোনার মেডেল আনার কথা। বদমাশ বাঘটাকে নিকেশ করার কথা আমিও অনেক ভেবেছি। কিন্তু শুনছি সেটা নাকি কোন তান্ত্রিকের বাঘ, সে তান্ত্রিক আবার মন্ত্র-তন্ত্র বশীকরণ জানে।”
করালীবাবু অঙ্ক আর বিজ্ঞান ছাড়া কিছুই মানেন না। তাই হা-হা করে হেসে বললেন, “কিছু ভাববেন না। আমাকে একটা মজবুত দেখে লাঠিসোটা যা হোক কিছু দিন তো! তারপর দেখবেন এনার্জি মোমেন্টাম আর ভেলোসিটির কাছে সব মন্ত্রতন্ত্র ধুলো হয়ে যাবে।”
গেম স্যার খুশি হয়ে বললেন, “সে আর বেশি কথা কী? জ্যাভেলিনটাই নিয়ে যান। বল্লমকে বল্লম, লাঠিকে লাঠি।”
তাই হল। ছেলেরা যখন যে যার বাড়ি গেল, রাস্তাঘাট যখন এন্টু নির্জন হল, তখন জ্যাভেলিনটা কাঁধে ফেলে করালীবাবু হন হন করে গোঁসাইবাগানের দিকে রওনা হলেন।
রাম কবিরাজ দাওয়ায় বসে তামাক খেতে খেতে আকাশ-পাতাল ভাবছিলেন। বাড়ির লোকেরা সব প্রবল কান্নাকাটি করছে। তিনিও কোনও উপায় বের করতে পারছেন
। বুরুন গোঁসাইবাগানের পাতালঘরে আছে। সেখানে পৌঁছানো শক্ত হলেও অসম্ভব নয়। খোনাসুর শর্টকাট রাস্তা বলে দিয়ে গেছে। যে-কোনও ভাল সাঁতারুর পক্ষেই সেখানে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু মুশকিল হল, বুরুনের ভিতরে মনের জোর সৃষ্টি করা। বুরুনের ইচ্ছাশক্তি না জাগলে সে মন্ত্র কাটিয়ে বেরোতে পারবে না।
ভেবে ভেবে রোগা হয়ে গেছেন কবিরাজমশাই। চোখের কোলে কালি।
হঠাৎ রাস্তা দিয়ে করালীবাবুকে একটা বল্লম কাঁধে হেঁটে যেতে দেখে রামবাবুর মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। তিন লাফ দিয়ে দাওয়া থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে গিয়ে করালীবাবুর কাছা টেনে ধরে বললেন, “করালীবাবু! চললেন কোথায়?”
করালীবাবু বুরুনের দাদুকে দেখে ব্যথিত মুখ করে বললেন, “বুরুনের জন্য আমরা সবাই দুঃখিত রামবাবু। আমি বাঘটাকে শিক্ষা দিতে যাচ্ছি।”
রামবাবু খুশি হয়ে তাঁর বিচক্ষণ চোখ দিয়ে কালীবাবুর চেহারাটা ভাল করে দেখে নিয়ে বললেন, “আপনার বীরত্বে ভারি আনন্দ পেলাম। যাওয়ার আগে দয়া করে আমার একটা পাঁচন খেয়ে যান, তাতে গায়ে বল হবে। আর সেই সঙ্গে দুটো-একটা গোপন শলা-পরামর্শও দিয়ে দেব। সব সময়ে বীরত্বে কাজ হয় না, কৌশলও চাই।”
এই বলে করালীবাবুকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন রামবাবু।
অনেকক্ষণ তাঁদের শলা-পরামর্শ চলল।
৯. শেষ ডাউন গাড়ি
সন্ধের পর আজও শেষ ডাউন গাড়ি ইস্টিশান ছেড়ে কু-ঝিক-ঝিক শব্দ তুলে চলে গেল। একটু বাদেই প্রতিপদের চাঁদ একগাল হাসি ছড়িয়ে আকাশে উঠে পড়ল। একপাল শেয়াল চেঁচিয়ে উঠল কোথায় যেন, আর সেই শব্দে পাড়ার কুকুরগুলো ধমক-ধামক শুরু করে দিল। আর হঠাৎ এ-সময়ে করুণ সুরে ডেকে উঠল ফেউ। সবাই জানে ফেউ হল বাঘের সঙ্গ।
ফেউয়ের ডাক মিলিয়ে যেতে না যেতেই ‘ঘ্রা-আ-ড়া-ড়া-ম ডাকে কেঁপে উঠল চারদিক। সেই শব্দে সন্ধেরাতেই লোকালয়ে নিশুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে। যে যার ঘরে বসে প্রাণভয়ে কাঁপে।
শহরের দক্ষিণ ধারে ভয়ংকর গোঁসাইবাগানের ঝোঁপঝাড়ের ভিতর দিয়ে নিঃশব্দে অকুতোভয়ে এগিয়ে চলেছেন কালী স্যার। কাঁধে জ্যাভেলিন। রাম কবিরাজ করালীবাবুর গায়ে একটা ভারি দুর্গন্ধ তেল মাখিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, শীতের রাতে ঠাণ্ডা জলে নামতে আর ভয় রইল না। এ ভারি দুষ্প্রাপ্য তেল। এটা মেখে দক্ষিণ মেরুতে গেলেও নিউমোনিয়া ধরবে না। তা, তেলটা বোধহয় ভালই হবে, কিন্তু ভারি বিশ্রী গন্ধ। কবিরাজমশাই করালীবাবুকে খানিকটা পাঁচনও খাইয়ে দিয়েছেন। সে পাঁচনটাও খেতে বিশ্রী। কিন্তু সেটা খাওয়ার পর থেকে মনটায় খুব ফুর্তি পাচ্ছেন করালীবাবু, আর মাথাটাও ঠাণ্ডা রয়েছে।
নিঃশব্দে সমুদ্রদিঘির ধারে এসে পৌঁছলেন করালী স্যার। একটা বাঁশঝোঁপের আড়ালে ছায়ায় দাঁড়িয়ে চারিদিকটা একটু হিসেব করে নিলেন। চারদিক ছমছম করছে। জ্যোৎস্নার মুখে যেন একটা ভুতুড়ে কুয়াশার ঠুলি। চারপাশে যেন ছায়া-ছায়া অশরীরী ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু ভয়-ভয় করল করালীবাবুর। মনে-মনে একটা রুটওভার করে ফেলতেই ভয়টা কেটে গেল। দিঘিটা সমুদ্রের মতোই বিশাল বটে। কিন্তু তাঁকে অতটা পার হতে হবে না। কবিরাজমশাইয়ের কথামতো ঠিক নিশানায় হেঁটে তিনি পশ্চিম দিকের ধারে চলে এসেছেন। এখান থেকে দক্ষিণের ঘাটে স্থলপথে যাওয়া আর নিরাপদ নয়। যেতে হবে জলে নেমে সাঁতরে। করালীবাবু হিসেব করে দেখলেন, এখান থেকে আগাগোড়া ডুব-সাঁতারে যেতে কম করে বিশ মিনিট লাগবে।
কিন্তু তাতে ঘাবড়ালেন না মোটই। শুধু জলে নামার আগে বাঁশঝোঁপের আড়ালে বসে মনে-মনে খুব শক্ত একটা ইকোয়েশন কষে ফেললেন।
তারপর জামা কাপড় খুলে শুধু একটা হাফপ্যান্ট-পরা অবস্থায় বাঁশঝোঁপের ছায়া থেকে সাপের মতো বুকে হেঁটে জ্যাভেলিন সমেত নিঃশব্দে জলে নেমে গেলেন করালীবাবু।
একটু শীত ছিল বটে, কিন্তু সে তেমন কিছু নয়। তবে অসুবিধে হচ্ছিল জলের তলাটা অন্ধকার বলে। কোনদিকে যাচ্ছেন, ঠিক নিশানায় এগোচ্ছেন কিনা তা বুঝতে পারছিলেন না। তবু নিঃশব্দে এগিয়ে চললেন। হঠাৎ টের পেলেন, তাঁর আশেপাশে খুব বড় বড় ডুবোজাহাজ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আতঙ্কে হিম হয়ে গেল তাঁর গা। সর্বনাশ! শত্রুপক্ষের যে ডুবোজাহাজ আছে, তা তো জানা ছিল না! তাড়াতাড়ি ভেসে উঠলেন করালীবাবু। আকাশে চাঁদের দিকে চেয়ে দশ লক্ষ দশ হাজার দশকে তিন লক্ষ তিন হাজার তিন দিয়ে ভাগ করে ফেললেন মনে-মনে। মনটা ভাল হয়ে গেল। ভাল করে চারদিকে চেয়ে দেখলেন, দক্ষিণের ঘাটে যেতে এখনও বেশ খানিকটা পথ বাকি। জ্যাভেলিনটা বাগিয়ে ধরে আবার ডুব দিতেই ভুল ভাঙল। ডুবোজাহাজ বলে যেগুলোকে ভেবেছিলেন, সেগুলো আসলে সমুদ্রদিঘির বিখ্যাত কালবোশ, চিতল, বোয়াল, কাতলা আর পাকা রুই মাছ। এ-দিঘির মাছ কেউ ভয়ে ধরে না, তাই বহুঁকাল ধরে বেড়ে-বেড়ে মাছগুলোর চেহারা হয়েছে পেল্লায়, গায়ে শ্যাওলা জমে গেছে।