খোনাসুর খুশি হয়ে বলে, “বড় উপকার হবে তাহলে কবিরাজ মশাই। আমাদের কথা তো কেউ ভাবে না। এই হাবু বদমাশটার কথাই ধরুন না। এখানে আসা ইস্তক কী অভৌতিক খাটানটাই না খাটাচ্ছে! বিছুটি-বন পরিষ্কার করো, কাঁটা-গাছ ওপড়াও, ঘর পরিষ্কার করো, দিঘির কচুরিপানা তোলো, এটা আনো, সেটা নিয়ে যাও, অমুককে খবর দাও, তমুককে ধরে আনন, কাজের শেষ নেই। তিন-ধা-নাচন নেচে মরছি। বাগে পেলেই হাবুর ঘাড় মটকাব।”
উৎসাহিত হয়ে রাম কবিরাজ বলেন, “সত্যি মটকাবে?”
“তবে আর বলছি কী? অবশ্য হাবুর ঘাড় মটকানো সহজ কাজ নয়। সে আমাদের মন্ত্রের জোরে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। ইচ্ছে থাকলেও কিছু করতে পারি না। তা বলে ভাববেন না যেন, আমরা সবাই হাবুর হুকুম খুশি হয়ে তামিল করছি। সুযোগ বুঝলেই আমরা কাজে ফাঁকি দিই। এক লহমার কাজ করতে তিন দিন লাগিয়ে দিই, তিন দিনের কাজ সারতে তিন মাস কাটাই। আরবারে হাবুর কালীপুজোয় ফটিকবাবু চাঁদা দেননি বলে হাবু রেগে গিয়ে আমাকে ডেকে বলল, যা তো, ফটিকের গোঁফ জোড়া উপড়ে নিয়ে আয়। আমি করলুম কী, ফটিকবাবুর গোঁফের বদলে তাঁর ছাগলের দাড়িগাছটা ছিঁড়ে নিয়ে গেলাম। হাবু প্রথমটায় বুঝতে পারেনি, পরে টের পেয়ে সে কী মার আমাকে! আমি মাথা চুলকে বললাম, আজ্ঞে অন্ধকারে ঠিক ঠাহর পাইনি। তখন আরও মারে দেখে বললাম, আজ্ঞে কানে ভাল শুনতে পাচ্ছি না। বুড়ো হচ্ছি তো, তাই ফটিক শুনতে ফটিকের ছাগল আর গোঁফ শুনতে দাড়ি শুনেছি। কিন্তু মানুষের উপকার করতে নেই কবিরাজমশাই। এই যে ফটিকবাবুর একটা উপকার করেছিলাম, তার জন্য বরং ফটিকবাবুই উল্টে কত না শাপ-শাপান্ত করেছেন। বলেছেন, যে-আমার ছাগলের দাড়ি ছিঁড়েছে তার ওলাউঠা হোক, সে নরকে যাক, নরকে যেন যমদূতেরা তাকে দশ হাজার বছর ধরে সেদ্ধ করে আরো দশ হাজার বছর ধরে ভাজে, তারপর আরও দশ হাজার বছর রোদ্দুরে ফেলে রেখে শুকোয়।”
কবিরাজমশাই সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, “আহা, বুঝতে পারেনি ফটিক। আমি তাকে বুঝিয়ে বলবখন। তুমি রাগ কোরো না বাবা খোনাসুর।”
এই বলে কবিরাজমশাই উঠে একটা কাগজের পুরিয়াতে একটু কর্পূর, গন্ধক, কালোজিরে, এলাচের গুঁড়ো, হিং এবং আরও কয়েকটা চূর্ণ মিশিয়ে টেবিলের ওপর রেখে বললেন, “এটা নিয়ে যাও। গায়ে-গতরে ব্যথা হলে বা হাঁফিয়ে পড়লে শুকে দেখো। এক শিশি কবিরাজী নস্যও নিয়ে যাও, ওই তাকে আছে। এতে যদি কাজ হয়, তবে আমি ভূতদের জন্য আরও নানা রকম ওষুধ বানাতে শুরু করব। আর সেই নতুন চিকিৎসাবিদ্যার নাম দেব ভৌত আয়ুর্বেদ।”
বাতাসের হাত বাড়িয়ে থোনাসুর পুরিয়াটা তুলে নিল। কবিরাজ মশাই দেখলেন পুরিয়াটা শূন্যে ভাসছে। খুব জোরে একটা শ্বাস টানার শব্দ হল। তারপর এক প্রবল হাচ্ছো। খোনাসুর বলে ওঠে, “আঃ! খুব কাজ হচ্ছে মশাই। গায়ের ব্যথাটা যেন হাঁচির সঙ্গে বেরিয়ে গেল। জব্বর ওষুধ।”
রাম কবিরাজ খুশি হয়ে বললেন, “ওষুধের জন্যে আর ভেবো না। লোকে আজকাল আর কবিরাজের কাছে আসতে চায় না, হাতুড়ে অ্যালোপ্যাথের দোরে গিয়ে ধরনা দেয়। সেইজন্য মানুষের চিকিৎসা করতে আর রুচি হয় না। এবার থেকে নাহয় ভূতেদের চিকিৎসা করে দেখব।”
খোনাসুর আর একবার হাঁচি দিয়ে বলল, “যে আজ্ঞে।”
রামবাবু গলায় আদর মাখিয়ে বললেন, “এবার বলো তো বাবা খোনাসুর, ছেলে দুটোকে উদ্ধার করি কোন উপায়ে?”
খোনাসুর ভয়-খাওয়া গলায় বলে, “ও বাবা! উদ্ধার করা বড় কঠিন কাজ কবিরাজমশাই। যদি বা কোনও রকমে উদ্ধার করতে পারেন, তবে বাঁচাতে পারবেন না।”
রামবাবু চিন্তিত হয়ে বললেন, “তাহলে উপায়?”
“যদি কোনও রকমে বুরুন নিজের মনের জোর খাঁটিয়ে বশীকরণের মন্ত্র কাটাতে পারে, একমাত্র তবেই সে উদ্ধার পাবে। এ বাইরের লোকের কাজ নয়। যা করবেন ভেবেচিন্তে করবেন…হ্যাঁ…হ্যাঁ…হ্যাঁচ্ছো…আঃ, আপনার ওষুধে খুব কাজ হচ্ছে মশাই।”
রামবাবু পরম তৃপ্তির সঙ্গে বললেন, “তা আর হবে না! আমি হলাম ডাকসাইটে রাম কবিরাজ, মড়া বাঁচাতে পারি”।
কিন্তু কথাটা ভাল করে শেষ করার আগেই কবিরাজ মশাই টের পেলেন যে, পুরিয়া সমেত শোনাসুর সাঁ করে পালিয়ে গেল। রামবাবু বার বার ডাকাডাকি করেও আর তার সাড়া পেলেন না। “কী হল রে বাবা” বলে কবিরাজমশাই ভাবতে লাগলেন। তারপর তাঁর খেয়াল হল, অন্যমনস্কভাবে তিনি খোেনাসুরের সামনে নিজের নামটা উচ্চারণ করে ফেলেছেন। ও নাম ওদের সহ্য হয় না। মনে মনে তিনি ঠিক করলেন, ভূতেদের চিকিৎসা যদি করতেই হয়–তবে ওদের সামনে নিজের নামটা ভুলেও মুখে আনা চলবে না।
৮. দোল পূর্ণিমার জ্যোৎস্না রাতে
করালীবাবু দোল পূর্ণিমার জ্যোৎস্না রাতে তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তায় পায়চারি করছিলেন। ভারি শক্ত একটা রুটওভার সকাল থেকে কয়বার চেষ্টা করছেন। পারেননি। পারবেন কী করে? সারাদিন গায়ের ছেলেবুড়ো হুল্লোড় করে রং খেলেছে। অত হুল্লোড়ে কি অঙ্ক হয়? অঙ্ক হয়নি বলে করালীবাবুর মাথাটা তেতে আগুন হয়ে গেল। প্রায়ই এরকম হয়। আর মাথা গরম হলে বরাবর, কী শীত কী গ্রীষ্ম, কী দিন কী রাত, করালীবাবু গিয়ে পুকুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গলা অবধি ডুবিয়ে বসে থাকেন। আর এই অভ্যাসের ফলে করালীবাবু নিজের অজান্তেই খুব বড় সাঁতারু হয়ে গেছেন। ইচ্ছে করলে তিনি পাঁচ, সাত, এমন কি দশ মিনিট পর্যন্ত জলের নীচে ডুব দিয়ে থাকতে পারেন। বলতে কী, সাঁতারের কম্পিটিশনে নামলে করালীবাবুকে হারানোর মতো লোক নেই।