টিং টিং করে মিষ্টি ঘণ্টা বাজতেই গার্ডসাহেব হুইসল দিয়ে গাড়ি ছাড়ার সঙ্কেত দিলেন আর বুরুনের দিকে চেয়ে বললেন, “উঠে পড়ো তাড়াতাড়ি!” গার্ডের মুখ দেখে বুরুন তো অবাক। এ যে অরণ্যদেবের সেই বেঁটে সঙ্গী গুরান!
একটা কামরায় উঠে পড়ে বুরুন। জানালায় বসে দেখে, রূপকথার দেশের মতো অলৌকিক সুন্দর এক দেশের ভিতর দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। সব কিছুই ছোট-ছোট, সব কিছুই খুব সুন্দর রঙের।
যে কামরায় বুরুন উঠেছে, তাতে অজস্র পুতুল বসে-বসে বিস্কুট খাচ্ছে আর চিকন সুরে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলছে। পুতুল-কুকুর ঘুরে ঘুরে ‘পুফ পুফ করে ডাকছে, বাঘ-পুতুল বলছে ‘হালুম হুলুম’, হাতি-পুতুল একটা বানর-পুতুলকে খুঁড়ে নিয়ে দোল দিচ্ছে।
একটা জঙ্গলের ধারে গাড়ি এসে ছোট্ট একটা স্টেশনে থামল। স্টেশনের নাম ‘চড়ইভাতি’। গুরান এসে সবাইকে বলল, “নেমে পড়ো, নেমে পড়ো। এখানে আজ চড়ইভাতি হবে।”
নেমে বুরুন সকলের সঙ্গে জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে থাকে। ভারি সভ্য-ভব্য জঙ্গল। কোথাও কাঁটাগাছ নেই, বিছুটি পাতা নেই। সুন্দর সুন্দর সব গাছ, ফুল, পাখি। ছোট ছোট বাঘ, সিংহ, হাতি, গণ্ডার ঘুরে বেড়াচ্ছে। নানা রঙের সাপ চলেছে নিজের কাজে। তাদের দেখে একদম ভয় করে না। একটা বাঘের গায়ে হাত বুলিয়ে দিল বুরুন। একটা সাপকে তুলে একটু আদর করে ছেড়ে দিল।
দিনের আলো ফুরোচ্ছে না। সূর্য আটকে আছে পাহাড়ের পিছনে। আর সেই সুন্দর নরম আলোয় জঙ্গলের মধ্যে লুকোচুরি। আলোছায়ায় ডোনাল্ড ডাক, টিনটিন, গুরান, ডাইনী বুড়ি, পুতুল আর জীবজন্তু মিলে কী যে হই-হুঁল্লোড় করে চড়ইভাতি হতে লাগল, তা বলে ফুরোয় না। ভুতুম এসে কাকুতি-মিনতি করে বলল, “বুরুনদা, কাল আবির দিয়ে খুব অন্যায় কাজ করেছি। আর হবে না, কান ধরছি।”
বুরুন গম্ভীর হয়ে বলে, “আর পিঁপড়ে?”
“সেও অন্যায়। এই দেখ, দশবার ওঠবোস করছি। এবার ভাব করবে তো?”
ভুতুমের এত ভাল স্বভাব হয়েছে দেখে খুশি হল বুরুন। ভাব করে ফেলল।
এত সুন্দর দেশ ছেড়ে আর কোথাও কখনো যাবে না বুরুন। মনে-মনে এ কথা সে ঠিক করে ফেলল।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। বুরুন আর ভুতুমকে খুঁজতে যে সব লোককে চারদিকে পাঠানো হয়েছিল, তারা ফিরে এসে খবর দিল–না, কোথাও তাদের পাওয়া গেল না।
এ খবর শুনে মন্মথবাবু শয্যা নিলেন। আর রামবাবু ঘন-ঘন তামাক খেতে লাগলেন। দু বাড়িতেই কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল।
সন্ধের শেষ ডাউন রেলগাড়িটা ইস্টিশান ছেড়ে চলে গেল। তার কু-ঝিক-ঝিক শব্দ মিলিয়ে যেতে-না-যেতেই চারদিক কাঁপিয়ে বাঘের ডাক উঠল–ঘ্রা-আ-আ-ম্! এক বার। দু বার। তিন বার। আর তখন চারদিকে হলুদ আলোর বান ডাকিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ উঠে পড়ল আকাশে। কিন্তু সেই জ্যোৎস্নাতেও চারদিকটা আজ বড় ভুতুড়ে দেখাতে লাগল।
রাস্তাঘাট ফাঁকা, জনশূন্য। পথে কুকুর-বিড়াল, পর্যন্ত নেই। সব দরজায় খিল পড়ে গেছে। হাড়কাঁপানো শীতের বাতাস বয়ে যাচ্ছে।
রাম কবিরাজ একা তাঁর দোকানঘরে বসে আছেন। আড্ডাধারীরা কেউ আজ আসেনি। চারদিক নিঃশব্দ। রাম কবিরাজ বসে বসে ভাবছেন আর তামাক খাচ্ছেন। ভাবতে-ভাবতে এক সময়ে হঠাৎ আপন মনে বলে উঠলেন, “হুঁ। তাহলে এই হল ব্যাপার!”
যেই কথাটা বলেছেন, অমনি তাকের উপর শিশি-বোতলগুলো ঠনঠুন করে নড়ে উঠল। রাম কবিরাজ অবাক হয়ে চারদিকে চেয়ে দেখলেন। ভাবলেন, মনের ভুল। আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “ই। তাহলে এই হল ব্যাপার!”
বলার সঙ্গে সঙ্গে আবার শিশি-বোতলের ঠুনঠুন শব্দ। রাম কবিরাজ জানেন, ঘাবড়ে গেলে বা উত্তেজিত হয়ে পড়লে কোনও দিন কোনও কাজ হয় না। এমনিতেও তিনি ভিতু মানুষ নন। কারণ, যারা সৎ ও ন্যায়পরায়ণ, তাদের ভয়ের কিছুই নেই। মনটাকে শক্ত করে তিনি ইষ্টনাম জপ করতে লাগলেন। জপ করতে করতেই বললেন, “কী চাও?”
কপাটের আড়াল থেকে খোনা সুরে কে যেন বলে, “জপ বন্ধ করুন, নইলে কাছে আসি কী করে? আমার সময় নেই, কাজের কথাটা বলেই চলে যাব।”
রাম কবিরাজ জপ থামিয়ে বলেন, “এবার বলো।”
খোনাসুর কপাটের আড়াল থেকে ঘরের মধ্যে চলে আসে। কিন্তু রামবাবু কাউকে দেখতে পান না। বাতাসের ভিতর থেকে স্বরটা বলে, “ভয় পাবেন না। আমরা সব বুরুনের বন্ধুলোক। আমার নাম খোনাসুর।”
“বুরুন কোথায়?”
“গোঁসাইবাগানের পাতালঘরে। সমুদ্রদিঘির দক্ষিণের ঘাটে জলের তলায় ছয় নম্বর সিঁড়ির গায়ে যে ফাটল আছে, সেইটেই হল সবচেয়ে সোজা রাস্তা। জলে ডুব দিয়ে ফাটলে ঢুকে দশ কদম হাঁটলেই পথ পাওয়া যাবে, যে পথ সোজা পাতালঘরে গেছে। সেখানে বুরুন আর ভুতুম দুজনেই আছে।”
“সেখানে যাওয়া যায় না?”
“তা যাবে না কেন? কৌশলে সব হয়। কিন্তু গিয়ে কিছু লাভ নেই। তারা সেখান থেকে আসতে চায় না।”
“সে কী?”
“আজ্ঞে সেই খবরটাই দিতে এলাম। হাবু তাদের বশীকরণ মন্ত্র দিয়ে আটকে রেখেছে। আমাদেরও মন্ত্রের জোরে বশ করে দিনরাত খাটাচ্ছে। একটুও জিরোতে পাই না। গা-গতরে ব্যথা। তা কবিরাজমশাইয়ের কাছে গাব্যথার কোনো ওষুধ আছে নাকি?”
“আছে। তবে সে মানুষের জন্য। তোমাদের কি আর সে ওষুধে কাজ হবে?”
“তাহলে শিগগির শিগগির আমাদের জন্যও ওষুধপত্র বের করে ফেলুন।”
রাম কবিরাজ চিন্তিত হয়ে বললেন, “কাজটা বড় সহজ নয় হে। প্রথমে ভেবে দেখতে হবে, তোমাদের যখন শরীরই নেই, তখন অসুখটা হয় কোথায়। নাড়ীর গতি দেখে যে কিছু বুঝব তারও কিছু উপায় নেই। তারপর ধরো, তোমাদের পেট নেই, কাজেই ওষুধ পেটে গিয়ে ক্রিয়া করবে না। তোমাদের গায়ে মালিশও চলবে না। কাজেই তোমাদের জন্য বায়বীয় ওষুধ বের করতে হবে। সে কাজ ভারি শক্ত। তবে আমি চেষ্টা করব।”