হঠাৎ ঘাটের ওপর থেকে একটা গম্ভীর গলায় প্রশ্ন এল, “তুমি ওখানে কী করছ?”
বুরুন অবাক হয়ে চেয়ে দেখে জটাওয়ালা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল চেহারা, গায়ে টকটকে লাল রঙের চাঁদর আর কাপড়। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। মুখে রাজ্যের দাড়িগোঁফ।
বুরুন ঘাটের একটা ডুবো-সিঁড়িতে গলা-জলে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বলে, “একটা ছেলে বোধহয় জলে ডুবে গেছে, তাই খুঁজছি।”
লোকটা কোনো সাধুটাধু হবে, গম্ভীর গলায় বলল, “এ দিঘির জলে মায়ের পুজো হয়, তাই কারো নামা বারণ, তুমি উঠে এসো।”
বুরুন একটু ভয় খেয়েছিল। আস্তে-আস্তে জল থেকে উঠে ঘাটে দাঁড়াতেই লোকটা ফের জিগ্যেস করল, “তুমি কে?”
বুরুন ভেজা গায়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমি বুরুন, ভেলু ডাক্তারের ছেলে, রাম কবিরাজ আমার দাদু।”
শুনে লোকটার মুখ একেবারে পাকা আমের মতো মিষ্টি হয়ে গেল। হেসে বলল, “তাই বলো! এসো এসো, আজ দোলের দিন তোমাকে মিষ্টিমুখ করাব। তোমার বাবা আর দাদুর সঙ্গে আমার খুব খাতির কিনা। এসো এসো।”
এই বলে লোকটা নিজেই এগিয়ে এসে বুরুনকে নড়া ধরে তুলে নিল। বুরুন টের পেল, লোকটার গায়ে অসুরের মতো জোর।
গোঁসাইবাগানের ঝোঁপ-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সরু রাস্তা। দিনের বেলাতেও আলো নেই। কেমন আবছা ভুতুড়ে ছায়া চারিদিকে। সেই রাস্তা দিয়ে লোকটা বুরুনের হাত শক্ত করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা বুরুনের ভাল লাগছে না। সে বলল, “আপনি কে?”
“আমি!” হা হা করে হেসে লোকটা বলে, “আমি একজন সাধু মানুষ। ভয় পেও না। একসময়ে এই গঞ্জে সবাই আমাকে ‘হাবু ওস্তাদ’ নামে চিনত। এখনো কেউ কেউ চেনে। তোমার দাদু আর বাবা তো খুব চিনবে।”
বুরুন যেন ইলেকট্রিক শক খেয়ে কেঁপে উঠল। এই তবে হাবু ওস্তাদ!
গোঁসাইবাগানের পোড়ো বাড়ির চারপাশের জঙ্গল সাফ করা হয়েছে। ঘরদোর সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ঘরে পাঁচ-সাতজন ষণ্ডা চেহারার লোক শুয়ে বসে আছে। তাদের চোখ রক্তবর্ণ, আর মাঝে-মাঝে “শিব স্বয়ম্ভু” বলে বিকট গলায় তারা হাঁক পাড়ছে। হঠাৎ মাটি কাঁপিয়ে “ঘ-ড়-ড়-ড়-ড়া-ম” করে কাছেই একটা বাঘ ডেকে উঠল। এত বিকট ডাক বুরুন জীবনে শোনেনি।
সে কেঁপে উঠতেই হাবু ওস্তাদ বলে, “ভয় নেই। ও আমার পোষা বাঘ। এত দিন জঙ্গলে ছিল, আমি ফিরে এসেছি খবর পেয়ে বাঘটাও ফিরে এসেছে।”
এত ভয় বুরুন জীবনে পায়নি। কাঁপা গলায় সে বলে, “আমাকে ছেড়ে দিন। আমি বাড়ি যাব।”
হাবু হেসে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “যাবে যাবে! তোমাকে একটু মিষ্টিমুখ করাই, জায়গাটা একটু ঘুরেটুরে দেখ। হয়তো এ জায়গা তোমার এত ভাল লেগে যাবে যে, আর নিজের বাড়িতে ফিরতেই ইচ্ছে করবে না।”
বুরুন হাবুর হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, “না না। আমি বাড়ি যাব।”
হঠাৎ হাবু তার চোখে হাত বুলিয়ে দিয়ে খুব আলতো গলায় বলল, “এমন সুন্দর জায়গা ছেড়ে কোথায় যাবে?”
বুরুন চোখে হাত বোলাবার সময় চোখ বন্ধ করে ছিল। চোখ চাইতেই সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।
কোথায় সেই পোড়ো বাড়ি? কোথায়ই বা সেই জঙ্গল? সে দেখতে পেল, কী সুন্দর বাগান! অজস্র, অসংখ্য ফুল ফুটে আছে, সুগন্ধে ম-ম করছে চারধার। গাছে-গাছে দোয়েল শ্যামা কোকিল ডাকছে। ফুলে-ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট্ট প্রজাপতির মতো পরী। একটা ছোট্ট নদী বয়ে যাচ্ছে তরতর করে। বাঁধানো ঘাটে একটা রঙিন নৌকো বাঁধা। সব কিছুই খুব ছোট-ছোট, খেলাঘরের মতো। কিন্তু ভারি সুন্দর। এখানে আকাশের রঙ সবুজ। রঙের বাক্সে যত রকম রঙ দেখা যায়, তো রকম রঙের ছোট বড় গোল চৌকো আর নানান আকৃতির মেঘ আকাশে ভাসছে। কোনো কোনো মেঘ খুব নিচু হয়ে প্রায় মাথা ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। মেঘগুলোর ওপরে চমৎকার ছোট ছোট বসবার গদি রয়েছে। একটা মেঘ তার কাছে এসে বলে উঠল, “চড়বে নাকি বুরুন? চলো তোমাকে বেড়িয়ে নিয়ে আসি।”
মন্ত্রমুগ্ধের মতো বুরুন উঠে পড়ল মেঘের কোলে। সাবানের ফেনার মতো নরম গদিতে বসে আস্তে আস্তে ওপরে উঠল। খুব ওপরে নয়, খুব বেশি হলে তিন তলার ছাদের সমান উঁচু হয়ে আস্তে আস্তে মেঘটা তাকে নিয়ে চলে।
অল্প দূরেই একটা ছোট পাহাড়, তার চূড়ায় বরফ জমে আছে। পাহাড়ের পিছনে সূর্য ডুবছে। কী আশ্চর্য! এই সূর্যের চেহারা অবিকল আহ্লাদী মানুষের মুখের মতো। তার ঠোঁট, নাক, কান, চোখ সব আছে। বুরুনকে দেখে সূর্য বলে উঠল, “তোমার হুকুম পেলেই আমি উঠব বা ডুবব।”
বুরুন অবাক হয়ে দেখল। তারপর বলল, “তুমি একটু থাকো, আমি সব দেখে নিই ভাল করে। তারপর ডুবো।”
মেঘটা বলে উঠল, “সূর্য ডুবলেও এখানে কখনো অন্ধকার হয়। চাঁদমামা আছে, তারা আছে, স্বপ্নের আলো আছে।”
একটা ছোট্ট রেল স্টেশনের ধারে তাকে নামিয়ে দিল মেঘ। স্টেশনের ঘরটা নানা রঙে রঙিন, প্ল্যাটফর্মে হলুদ মোরাম! ছোট বাতিদানে সবুজ-লাল-নীল আলো জ্বলছে। খুদে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে শাস টানছে। কামরার জানালায় অদ্ভুত মজার মজার সব মুখ দেখে বুরুন। একটা জানালায় ডোনাল্ড ডাককে দেখতে পায়, অন্য জানালায় টিনটিন আর ক্যাপটেন মুখোমুখি বসে একটা গুপ্তধনের প্ল্যান দেখছে, টিনটিনের কুকুর কুটুস একটা ডাইনী বুড়িকে তাড়া করে অন্য কামরায় উঠিয়ে দিয়ে এল। একটা কামরার জানালায় দেখল, ভুতুম বসে আছে। কিন্তু ভুতুমের সঙ্গে ঝগড়া বলে তার দিকে ভাল করে তাকাল না বুরুন।