আড়াই মাইল দূরে করালীবাবুর বাড়িতে রোজ অঙ্ক শেখার জন্য হেঁটে যাতায়াত করতে হবে জেনে বুরুনের ভারি রাগ হচ্ছিল।
সেটা বুঝতে পেরেই বোধহয় বাবা বললেন, “কষ্ট না করলে মানুষ হওয়া যায় না। তোমরা বড় বেশি আদরে মানুষ হচ্ছ, তাই কোনো ব্যাপারেই তেমন গা নেই। রবীন্দ্রনাথ কত বড়লোকের ছেলে হয়েও চাকরদের মহলে মানুষ হয়েছেন। আমিও ঠিক করেছি, এবার থেকে তোমাদের আরাম আয়েস বিলাসিতা সব বন্ধ করে দেব। এখন থেকে অনেক কষ্ট করতে হবে তোমাদের। অঙ্ক শেখবার জন্য রোজ পাঁচ মাইল হাঁটা হল এক নম্বর কষ্ট। এর পর দু’নম্বর, তিন নম্বর আরো বহু কষ্ট আছে। তৈরি থেকো!”
বলে বাবা বেরিয়ে গেলেন।
বুরুন অঙ্কে তেরো পাওয়ায় বাড়ির সবাই চুপচাপ, কেউ তার সঙ্গে বিশেষ কথা বলছে না। মা না, ছোট ভাই-বোন গুরুন আর বেলীও না। বেলীকে একবার পিঠ চুলকে দিতে বলেছিল বুরুন। বেলী জবাব দেয়, “তোমার সঙ্গে বেশি মিশতে বাবা বারণ করেছে। তুমি দেয়ালে পিঠ ঘষে নাও, তাতেই চুলকোনো হবে।”
বুরুন বুঝতে পারল বাড়ির লোক তাকে একঘরে করেছে।
পরীক্ষার পর ইস্কুল এখনো বসেনি। সারা দিনটা খুব ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে খুব বেশি মেলামেশা বারণ হয়ে গেছে। শুধু বিকেলে খেলাধুলো করার হুকুম আছে ঘণ্টা দেড়েকের জন্য। বুরুনের তাই মেজাজ অসম্ভব খারাপ। বাড়িতে একমাত্র দাদুই তার সঙ্গে আগের মতো কথাবার্তা বলেন, ভালও বাসেন। কিন্তু দাদুর সঙ্গে বেশিক্ষণ সময় কাটানোর উপায় নেই। তিনি দিনরাত কবিরাজি ওষুধ তৈরি করতে ব্যস্ত। দাদু কবিরাজির ধাতব আর ভেষজ দু রকম চিকিৎসাই করেন। দিনরাত তিনি হিরেভস্ম, মুক্তাভস্ম, স্বর্ণসিন্দুর বানাচ্ছেন, মাঠে ঘাটে ঘুরে বেলগাছের মূল, কন্টিকারি, থানকুনি, আরো কত কী পাতা তুলছেন। তারপর সেগুলো থেকে ওষুধ তৈরি করছেন। অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার ওপর তাঁর ভারি রাগ। নিজের ছেলে ডাক্তার বলে তিনি পাত্তাও দেন না। সন্ধেবেলা তাঁর বাজারের দোকানঘরে যখন বুড়োদের আড্ডা বসে, তখন সকলের সামনেই তিনি বলেন, “ভেলু আবার ডাক্তার নাকি! এখনো নাড়ী দেখতেই শিখল না!”
বাড়িতে বুরুন আজকাল বড় একা, অঙ্কে তেরো পেলে কী হয়, তা সে হাড়ে হাড়ে বুঝছে আজকাল।
দুপুরবেলা বাড়িটা নিঝুম হয়ে গেছে। বাবা কল পেয়ে শহরের বাইরে গেছেন। মা, গুরুন আর বেলী ঘুমোচ্ছ। দাদু আর শিবু চাকর উঠোনে হামানদিস্তায় শুকনো ভাঙপাতা গুঁড়ো করছে। তাদের বেজিটা ঘুরঘুর করছে সেখানে।
বুরুন তাদের পোষমানা পাখির খাঁচার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ময়নাটা বলে উঠল, “বুরুন অঙ্কে তেরো পেয়েছে। বুরুন অঙ্কে তেরো পেয়েছে। বুরুন অঙ্কে–”
বুরুন ভারি অবাক হয়ে যায়। পাখিটাকে একথা কবে কে শেখাল? পাখিটা খুবই চালাক, দু-পাঁচবার শুনেই যে-কোনো কথা টপ করে শিখে নেয়। নিশ্চয়ই এর মধ্যে কেউ ওকে এটা শিখিয়েছে বুরুনকে জব্দ করার জন্য।
পুরোপুরি জব্দ হওয়ার অবশ্য বাকিও খুব একটা নেই। বুরুনকে আজকাল তার নিজের ময়লা জামা-প্যান্ট নিজেকেই কাঁচতে হয়। নিজের এঁটো থালা বাটি গেলাস নিজেকেই মাজতে হচ্ছে। তাছাড়া আছে নিজের জুতো বুরুশ করা, নিজের বিছানা পাতা এবং মশারি টাঙানো, পড়ার ঘর সকাল-বিকেল ঝাঁট দেওয়া। বাড়িতে ভাই-বোন বা চাকরবাকর কাউকে কোনো কাজের ফরমাস করা তার বারণ। এসব অপমান তবু গায়ে লাগে না, কিন্তু পোষা পাখির মুখে তার অঙ্কে তেরো পাওয়ার স্লোগান শুনে সে সত্যিকারের রেগে গেল। কটমট করে চেয়ে রইল পাখিটার দিকে। তারপর কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চুপচাপ বেরিয়ে পড়ল।
শীতের দুপুর। ভারি উষ্ণ কোমল রোদ। পাড়ার মাঠে ছেলেরা ব্যাটবল খেলছে।
বুরুন আনমনে হাঁটতে হাঁটতে ছোট গঞ্জমতো শহর ছাড়িয়ে একেবারে গোসাঁই ডাকাতের বাগানে এসে পড়ল।
২. গোঁসাই ডাকাতের বাগান বা গোঁসাইবাগান
গোঁসাই ডাকাতের বাগান বা গোঁসাইবাগান একটা বিশাল জঙ্গুলে জায়গা। জঙ্গলের মধ্যে একটা ভাঙা বাড়ি আছে, পুকুর আছে। আর আছে বুনো কুল আর বন-করমচার অজস্র গাছ। এরকম কুল আর কোথাও হয় না। দেখতে মটরদানার মতো ছোট, পাকলে ভারি মিষ্টি। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে এত সাপখোপ, বিছুটির গাছ আর কাঁটাঝোঁপ যে, বুনো কুল খাওয়ার লোক জোটে না। পাখি-পক্ষীতেই খেয়ে যায়। যে গাছগুলো একটু নাগালের মধ্যে, সে গাছের ফল ধরতে না ধরতেই ছেলেরা দল বেঁধে এসে খেয়ে যায়। ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে বেশি কেউ যেতে পারে না বলে পুকুরের দক্ষিণ দিকটায় অবশ্য কুলগাছের কুল যেমন-কে-তেমন থাকে। মরসুম ফুরোলে ফল পড়ে মাটিতে আরো গাছ জন্মায়। জঙ্গল বাড়ে।
বুরুনের মন খারাপ। আর মন খারাপ থাকলে কত কী কাণ্ড বাধাতে ইচ্ছে হয়। যেমন এখন তার ইচ্ছে হল যেমন করেই হোক ওই দুর্গম জায়গায় গিয়ে খুব নিরিবিলিতে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকবে আর বুনো কুল খাবে। যদি সাপে কামড়ায়, তা হলে নাহয় মরবে। মরাই ভাল। যদি বিছুটি লাগে তো লাগুক। তার মনের মধ্যে যে অপমানের জ্বালা, তার চেয়ে বিছুটির জ্বালা আর এমন কী বেশি হবে।
বুরুন মনের দুঃখে বনে ঢুকল। ঢুকেই বুঝতে পারল, এই দুর্ভেদ্য জঙ্গল পার হয়ে বুনো কুলের কুঞ্জবনে পৌঁছনো অসম্ভব। কাঁটা বা বিছুটি গ্রাহ্য নাহয় না-ই করল, কিন্তু এগোবার পথ চাই তো। যেদিক দিয়েই যেতে চেষ্টা করে, সেদিকেই ডালপালার রোগা-রোগা হাত বাড়িয়ে গাছ-গাছালি তার পথ আটকে ধরে।