রঙ-মাখা বুরুন অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আর এক পাল ছেলে এসে পিচকারিতে তাকে ভিজিয়ে দেয়। পচা ডিম ছুঁড়ে দেয় কে যেন। তাই বুরুন আর বাড়ি ফিরল না। ছেলের দলের সঙ্গে মিশে পাড়ায়-পাড়ায় রঙ খেলতে বেরিয়ে পড়ল।
আবির দিয়ে দোলখেলা শুরু হয়েছিল। সেইসঙ্গে গোলা রঙ। শেষে আলকাতরা, কাদা আর গোবর। রঙে রঙে ভূত হয়ে যেতে লাগল সবাই। শেষে এমন অবস্থা হল যে, কে কোন লোক তা আর চিনবার জো রইল না। রাস্তাঘাটে সবাই সঙ সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু কাউকেই চেনা যাচ্ছে না।
বুরুন রঙ-মাখা ছেলেদের মধ্যে ভুতুমকে খুঁজছিল। আর কিছুর জন্য নয়, ভুতুমকে পেলে তার কানদুটো আচ্ছাসে মলে দিয়ে মাথায় দুটো চাঁটি দেবে। বড্ড বেয়াড়া হয়েছে ছেলেটা।
অনেক খুঁজে বকুলতলার কাছে ভুতুমকে দেখতে পেল বুরুন। নর্দমার পাঁক তুলে রাস্তার লোকের গায়ে ছুঁড়ছে। বুরুন গিয়ে তাঁর একটা কান পাকড়ে মাথায় একটা রাম চাঁটি দিয়ে বলে, “খুব যে সকালে লঙ্কার গুঁড়ো দেওয়া আবির দিয়েছিলি! এখন?”
ভুতুম ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠে বলে, “দাঁড়াও দাদাকে ডেকে আনছি। কালও তুমি চাঁটি দিয়েছিলে বিশুদা, আর মার্বেল কেড়ে নিয়েছিলে…”
বুরুন ভুল বুঝতে পেরে জিভ কাটে। ভুতুম নয়, ক্লাস ফোরের ছিচকাঁদুনে ফুচু। অবশ্য ফুচুও তাকে চিনতে পারেনি, বিশু বলে ভুল করেছে। বুরুন তাড়াতাড়ি সরে পড়ল।
কুমোরপাড়ায় অবশেষে বুরুন ভুতুমকে পেয়ে যায়। রঙের বালতিতে কেরোসিন মেশাচ্ছে। বুরুন গিয়ে তাকে হাত চেপে ধরে বলে “ভুতুম! এবার কোথায় পালাবি? সকালে যে বড়–”
ভুতুম অবাক হয়ে চেয়ে বলে, “দ্যাখ মোনা, ফের ইয়ার্কি করবি তো সেদিনের মতো গুলতি মারব। আমাদের পাড়ার ছেলেকে ল্যাং মেরে মার খেয়েছিলি সেদিন, তবু লজ্জা নেই?”
বলে ভুল-ভুতুম টক করে প্যান্টের পকেট থেকে গুলতি বের
করতেই বুরুন ভোঁ-দৌড়। পিছন থেকে একটা ছুটন্ত গুড়ল তার পিঠের হাড়ে ঠং করে এসে লাগল। আগে হলে নিধিদা ঠিক গুড়লটা অন্য দিকে উড়িয়ে দিত। কিন্তু নিধিরাম তো এখন আর নেই।
ভুতুমকে খুঁজতে গিয়ে বারকয়েক এরকমভাবে ভুল-ভুতুমের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বুরুনের। অবশ্য তারাও কেউ বুরুনকে চিনতে পারেনি।
খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে বুরুন রথতলায় একটা জামগাছের নীচে শান্তশিষ্ট একটি ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। ভারি শান্তভাবে রঙিন ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে, হাতে কোনো পিচকিরি না খারাপ রঙ নেই। শুধু একটু আবির। বুরুন তাকে গিয়ে জিগ্যেস করল, “হ্যাঁ খোকা, নোয়াপাড়ার ভুতুমকে এদিকে কোথাও দেখেছ?”
ছেলেটা হাসি-হাসি মুখ করতেই তার দাঁতে লাল নীল রঙ দেখা গেল। ছেলেটা খুব ভাল গলায় বলে, “হ্যাঁ দেখেছি। কিন্তু তুমি কে বলো তো?”
“আমি বুরুন।”
“ও, চ্যাম্পিয়ন? তুমি হলে শহরের গৌরব। আমাদের বাসায় তোমাকে নিয়ে খুব আলোচনা হয়। এসো, তোমাকে একটু আবির দিই! দেব তো? মনে কিছু করবে না তো?”
ছেলেটার এরকম ভদ্র আর সুন্দর ব্যবহারে বুরুন মুগ্ধ হয়ে গিয়ে বললে, “কেন আবির নষ্ট করবে ভাই? আমার গায়ে আর রঙ দেওয়ার জায়গাই নেই যে।”
ছেলেটা করুণ স্বরে বলে, “কিন্তু ছুটে কারো সঙ্গে পারি না বলে আজ যে আমি কারো গায়ে রঙ দিতে পারিনি!”
বড় মায়া হল শুনে, তাই বুরুন মুখটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “তাহলে দাও।”
ছেলেটা হুশ করে হাতের আবির বুরুনের মুখে ছুঁড়ে দিয়েই দৌড়। আর লঙ্কার গুঁড়ো মেশানো ঝাল আবিরে বুরুনের চোখ-মুখ জিভ জ্বলে যেতে লাগল। ছেলেটা দৌড়তে দৌড়তেই চেঁচিয়ে বলল, “দুয়ো! দুয়ো! আমিই ভুতুম। ধরতে পারলে না!”
রাগে বুরুনের মাথার ঠিক রইল না। সে চোখ মুছতে মুছতেই শব্দ লক্ষ করে ভুতুমকে ধাওয়া করে যেতে লাগল। পায়ের শব্দে আর গলার স্বরে বুঝতে পারল যে, ভুতুম যাচ্ছে গোঁসাইবাগানের দিকে। শহরের সবচেয়ে ভাল পুকুরটা ওই দিকেই। গোঁসাইবাগানের কাছে বিশাল পুকুরটাকে লোকে বলে সমুদ্রদিঘি। সারা বছর টলটলে জলে ভরা থাকে। ওরকম ভাল জল আর কোথাও নেই। কিন্তু অনেকটা দূরে বলে আর ভয়ের জায়গা বলে। লোকে সেখানে বড় একটা স্নান করতে যায় না।
বুরুন পরিষ্কার শুনতে পেল ভুতুম দৌড়ে গিয়ে সমুদ্রদিঘিতে ঝাঁপ দিয়ে চেঁচাল, “দুয়ো! ধরতে পারল না!”
বুরুনও দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়ে দিঘিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জলে কিছুক্ষণ নাকানি-চোবানি খাওয়ার পর চোখ পরিষ্কার হয়ে আসে। তখন চারদিকে চেয়ে সে ভুতুমকে খোঁজে।
.
কিন্তু পুকুরে জনপ্রাণী নেই। চারিদিকে ঠাণ্ডা নিস্তরঙ্গ জল। কোথাও একটা ভুরভুরিও দেখা যায় না। তবে দিঘিটা এত বিশাল যে, সবটা নজর করা মুশকিল। বদমাশ ভুতুম নিশ্চয়ই ডুব-সাঁতার দিয়ে কোথাও ভেসে উঠবে ভেবে বুরুন অনেকক্ষণ জলে সাঁতরে বেড়াল। কিন্তু ভুতুম কোথাও ভেসে উঠল না। ডুবে গেল নাকি ছেলেটা? কিন্তু ডোববার ছেলে তো ভুতুম নয়! চৌপর দিন সে তার বাড়ির পাশের পুকুরটায় পড়ে থাকে। চিত, ডুব, কাত–কোনো সাঁতারই তার অজানা নয়। দমও আছে অনেক। তবে ভুতুমের হল কী?
খোঁজাখুঁজি করতে করতে বুরুন দক্ষিণের ভাঙা ঘাটের কাছে চলে এল। ডুবে-ডুবে পা দিয়ে দিঘির তলায় খুঁজতে লাগল। যদি ভুতুম ডুবে গিয়ে থাকে, তবে ওর শরীরটা তো থাকবে নীচে।