বুরুনের বাবা এসব কথায় তেমন গুরুত্ব দেন না। তবে শুনে একটু-আধটু খুশি যে না হন, তা নয়। কিন্তু খুশি হয়ে রাশ আলগা করেন না। ছেলেকে কড়া শৃঙ্খলায় রাখেন।
দোলের দিন সকাল হতে-না-হতেই রাস্তা থেকে ছেলেদের হল্লা ভেসে আসছিল। ছেলেরা রং নিয়ে একে-ওকে তাড়া করছে। খুব হাসছে। চেঁচাচ্ছে।
বুরুন তখন নিজের পড়ার ঘরটিতে বসে দাঁতে দাঁত চেপে অঙ্ক কষে যাচ্ছে। আজকাল দিনে গড়পড়তায় কুড়িটা করে কঙ্ক কষতে হয়। কালীবাবুর দেওয়া বোমার মতো অঙ্ক সব। দাঁত বসানোই শক্ত। পরশু পর্যন্ত এসব অঙ্ক জলের মতো সহজে করে ফেলেছে বুরুন। না, ঠিক বুরুন করেনি-বুরুনের হাত দিয়ে সেগুলো কষে দিয়েছে আসলে নিধিরাম। কিন্তু কাল থেকে নিধিরামের পাত্তা নেই। এমন কী, যে সব নতুন শিক্ষার্থী ভূত নিধিরামের দূত হয়ে আশেপাশে থাকত, তাদেরও কারো টিকি দেখা যাচ্ছে না। অনেক ডাকাডাকিতে কাল দুপুরবেলা কয়েক মুহূর্তের জন্য নিধিরাম এসেছিল। তার সারা গায়ে মাটি মাথা, চোখ দুটো করুণ, ঘাম হচ্ছে খুব। বলল, “আর বোলো না, গোঁসাইবাগানের জঙ্গল সাফ করছি, হাবু ওস্তাদ এসে গেছেন কিনা। এসেই হুকুমের পর হুকুম চালাচ্ছেন। কাজ কি সোজা! বিছুটি-বন কাটতে হলে বুঝতে পারতে।”
বুরুন কান্না-কান্না মুখ করে বলে, “তুমি না থাকলে আমার অঙ্ক কি ট্রানস্লেশন কে করে দেবে বলো তো নিধিদা?”
নিধিরাম গম্ভীর হয়ে বলে, “দ্যাখো বুরুন, যা করেছি তা করেছি। এখন ওসব ভুলে যাও। আমাকে আর বড় একটা পাবে না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখো এবার।”
বুরুন তখন লোভ দেখিয়ে বলে, “আমি ঠিক তোমাকে ভয় খাব এবার থেকে, দেখো।”
নিধি হেসে বলে, “এখন আর ভয় দেখানোর সময় নেই যে। স্বয়ং গোঁসাইবাবা পর্যন্ত হাবুর ঘর ঝাঁট দিচ্ছেন। দম ফেলার ফুরসত নেই। তুমি আর কতটুকুই বা ভয় খাবে? আমরা হাবুকে যা ভয় খাচ্ছি, সে আর বলার নয়।”
বুরুন বলল, “হাবু হুকুম দিলে সব কিছু করতে পারো, নিধিদা?”
নিধিরাম হেসে বলে, “সব কি পারি রে ভাই? আমাদের হল গিয়ে হাওয়া-বাতাসের শরীর। তা সেই হাওয়া-বাতাসের জোর দিয়ে যা করা যায় সেসব পারি।”
বুরুন বলে, “আমার দাদু রাম কবিরাজের ঘাড় যদি মটকাতে বলে হাবু, মটকাবে?”
নিধি কবিরাজমশাইয়ের নাম শুনেই সাঁত করে মিলিয়ে গেল বাতাসে। বুরুন অবাক। পরে ভেবেচিন্তে দেখল, নিধিরামের সামনে দাদুর নামটা উচ্চারণ করা ঠিক হয়নি। ‘রাম’ নামকে কোনো ভূত সহ্য করতে পারে?
সেই যে গেছে নিধিরাম, অনেক ডাকাডাকিতেও আর আসেনি। তাই কাল থেকে বুরুনকে তার অঙ্ক ট্রানস্লেশন সব নিজেকেই করতে হচ্ছে। কাল করালীবাবুর বাড়িতে পড়তে গিয়ে বুরুন খুব বিপদে পড়েছিল। করালীবাবু যা-ই জিগ্যেস করেন, তা-ই বলতে না পেরে বুরুন হাঁ করে থাকে। কালীবাবু খুব অবাক হয়ে বললেন, “সে কী বুরুন? আমি যে ভেবেছিলাম, তুমি আইনস্টাইনের মতো একজন কেওকেটা হবে! কালও তো তুমি সাঙ্ঘাতিক সাঙ্ঘাতিক সব অঙ্ককে ঘায়েল করে গেছ!”
কাল ইস্কুলে ট্রানস্লেশনও পারেনি বুরুন, ভূগোল ক্লাসে ভুল করেছে। ছুটির পর খেলতে গিয়ে শূন্য রানে আউট হয়েছে, বলও করেছে যাচ্ছেতাই। তার অবনতি দেখে গেম টিচার পর্যন্ত অবাক।
আজ তাই বুরুনের বড় মন খারাপ। পড়ার টেবিলের সামনেই জানালা। সেটা দিয়ে রাস্তার দৃশ্য দেখা যায়। একটাও অঙ্ক না মেলাতে পেরে বুরুন খুব অন্যমনস্কভাবে বাইরের দিকে চেয়ে ছিল। আজ দোল। সবাই রং খেলছে। সে খেলবে না। তার ওপর নিধিরাম ছেড়ে গেছে তাকে। হাবু গুণ্ডা এসেছে দাদুকে জব্দ করতে।
কত কী ভাবছিল বুরুন। ঠিক এসময়ে জানালা দিয়ে একটা রঙ-মাখা মুখ উঁকি দিল। বুরুন সাবধান হওয়ার আগেই একমুঠো ঝাল আবির উড়ে এল তার চোখেমুখে। অঙ্কের বই-খাতা ভাসিয়ে গোবর-গোলা ম্যাজেন্টা রঙ ছড়িয়ে পড়ল। আর ভেঁও আর কাঠপিঁপড়ে বোঝাই একটা ফাঁপা ডিমের খোলা তার কপালে লেগে ভেঙে গিয়ে পিঁপড়ে বাইতে লাগল সবাঙ্গে!
লঙ্কার জ্বলুনি আর পিঁপড়ের কামড়ে মুহূর্তের মধ্যে বুরুন তিড়িং তিড়িং লাফাতে থাকে। রাগে তার পিত্তি জ্বলে যায়। “নিধিদা, নিধিদা,” বলে বারকয়েক ডেকে খেয়াল করে যে, নিধিরাম হাবুর বেগার খাটছে, আসবে না। তখন ভুতুমকে ধরার জন্য বুরুন দুই লাফে ঘর থেকে রাস্তায় পড়ল।
ভুতুম দৌড়ে পালাচ্ছে। বুরুন তাকে ধাওয়া করতে-করতে ভাবে, কতক্ষণ দৌড়বে। এই ধরলাম বলে।
কিন্তু স্পোর্টসে সে যেরকম বিশ্বরেকর্ড-ভাঙা দৌড় দৌড়েছিল, এখন তার দৌড়ের বহর সেরকম তো নয়ই, উপরন্তু ভুতুমকে ধরতে খানিক দৌড়ে সে হাঁফিয়েও উঠল। রাস্তার ছেলেমেয়েরা খুব চেঁচিয়ে বুরুনকে সাবাশ দিচ্ছিল। তারা ভাবছিল গঞ্জের চ্যাম্পিয়ন স্পোর্টসম্যান, যে কিনা একদিন অলিম্পিক থেকে একাই এক ডজন সোনার মেডেল আনবে বলে সবাই জানে, এক্ষুনি ভুতুমকে ধরে ফেলবে।
কিন্তু আজ মোটেই তা হল না। ভুতুম অনায়াসে দৌড়ে অনেক দূর চলে গিয়ে পিছু ফিরে দু হাতে কাঁচকলা দেখাতে লাগল বুরুনকে। মুখে হি-হি হাসি।
গোমড়ামুখে বুরুন ফেরত আসছিল, কিন্তু মাঝপথে একপাল ছেলে তাকে ধরে আচ্ছাসে রঙ মাখায়। বুরুন গায়ের জোর খাঁটিয়ে সব কটাকে হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে দেখল যে, সে একটাকেই কায়দা করতে পারছে না। অথচ পরশুদিন পর্যন্ত তার গায়ে সাতটা হাতির জোর ছিল, কোনো ছেলে লাগতে সাহস পেত না।