কবিরাজমশাই হাবুর কথা তুলতেই ছোঁকরা দারোগা শম্ভুচরণ বলে ওঠে, “ওঃ, দ্যাট ফেমাস রোগ? না, এবার আর তার কোনো জারিজুরি খাটবে না।”
রাম কবিরাজ হেসে বললেন, “তেড়েমেড়ে ডাণ্ডা, করে দেবে ঠাণ্ডা? না হে বাপু, কাজটা অত সহজ নয়।”
বাবুরাম সাপুড়ের সেই কবিতা বোধহয় শম্ভুচরণ পড়েনি। যাই হোক, সে একটু ডাঁটের সঙ্গে বলল, “নাকে তেল দিয়ে ঘুমোন গে কবিরাজমশাই, হাবুকে কাবু করতে আমার দু’দিনও লাগবে না। অবশ্য সে যদি গোলমাল করে।”
দোলের কয়েক দিন আগে গঞ্জে কিছু কিছু সন্দেহজনক চেহারার লোকের আনাগোনা হতে লাগল। তারা আড়ে আড়ে চায়, গোমড়ামুখ করে ঘোরে ফেরে, কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলে না।
হরিহরবাবু সাইকেলে চেপে তিস্তাঘাটে গিয়েছিলেন। সন্ধের মুখে ফিরবার সময় গঞ্জের উত্তর দিকের শাল-জঙ্গলের মধ্যে বাতাস শুকে বাঘের গন্ধ পেলেন। এত জোরে সাইকেল চালিয়েছিলেন যে, দু’-চাকার গাড়িখানা শেষমেশ চাকায় ভর দেওয়া ছেড়ে যেন পাখনায় ভর করল। বাজারের কাছে এসে “বাঃ…বাঃ” বলে চেঁচাতে-চেঁচাতে অজ্ঞান হয়ে গেলেন সাইকেলসুদ্ধ।
লোজন ভিড় করে এল। একজন বলতে লাগল, “উনি ‘বাঃ বাঃ’ বলে কাকে যেন বাহবা দিচ্ছিলেন এইমাত্র। তবে পড়লেন কেন?”
অন্যজন বলল, “উনি এত জোরে সাইকেল চালিয়েছিলেন যে, নিজের এলেম দেখে নিজেকে নিজেই বাহবা দিচ্ছিলেন।”
একটা বাচ্চা ছেলে তার বাবাকে জিগ্যেস করল, “সাইকেলটাও কি অজ্ঞান হয়ে গেছে বাবা?”
সনাতনবাবুর বড় দাবার নেশা, সারাদিন দাবাড় খুঁজে বেড়ান। তা, গঞ্জে ভাল দাবাড় আর ক’জনই বা আছে? যারা আছে, তাদেরও তো সব সময়ে পাওয়া যায় না। সনাতনবাবু আবার মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে উঠে হ্যারিকেন উসকে দাবার ছক পেতে বসেন। তখন সঙ্গীসাথী আর পাবেন কোথায়, তাই একা একাই খুঁটি সাজিয়ে দু দিকেই চাল দেন। এরকম এক রাতে খেলতে বসেছেন। হঠাৎ দেখেন, তাঁর উল্টো দিকের খুঁটি আপনা থেকেই চলছে। আর কী অসাধারণ সব চাল! খেলা শুরু হতে হতেই বারো চালের মাথায় ঘোড়া আর গজের মুখে মাত হয়ে গেলেন। খেলা যখন চলছিল, তখন দাবার নেশায় অত খেয়াল করেননি। খেলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ “বাপরে” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। ভয়ে তাঁর দাঁত-কপাটি লাগল।
তবে একথা ঠিক যে, গঞ্জে বাঘের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল এবং অলৌকিক সব কাণ্ডও ঘটতে শুরু করেছিল।
রাম কবিরাজের দোকানে সবাই খুব গম্ভীর হয়ে বসে আছেন সন্ধেবেলায়।
কমলাক্ষবাবু কস্ফটার জড়িয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে হাজির হয়ে বললেন, “আর বোলো না। দামি শালটা–”
“শালটা কী হল?”
রামবাবু উদ্বিগ্ন হয়ে জিগ্যেস করেন। “নিয়ে গেল।”
“কে?”
“আর কে!”
সবাই মুখের দিকে চেয়ে আছেন, কিন্তু কমলাক্ষবাবু এর বেশি বলতে রাজী হলেন না।
রাম কবিরাজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “নিয়তি কে ন বধ্যতে।”
মন্মথবাবুও সেই কথায় সায় দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “সেকথা ঠিক। আমরা যতই না কেন সাবধান হই, নিয়তি মারলে কিছু’করার নেই।”
রামবাবু কটমট করে তাঁর দিকে চেয়ে বললেন, “আমি আমাদের কথা বলিনি। আমাদের নিয়তি ঠিক আছে। আমি হাবু গুণ্ডার নিয়তিটাই দেখছি।”
মন্মথবাবু চারপাশ চোরা চোখে দেখে নিয়ে বললেন, “ও নাম মুখে এনো না। কে কোথায় শুনতে পাবে।”
কমলাক্ষবাবুও বললেন, “কবরেজ, তোমার সাহসটা একটু কমাও। সাহস ভাল, কিন্তু অতি সাহস ভাল নয়।”
সারা-রা-রা ঢেক চলি যা ঢেক চলি যা ঢেক চলি যা…। সারারাত দেহাতীদের বস্তিতে দোলের সঙ্গে গান হয়েছে। ভোর হলেই দোল।
ছেলেমেয়েরা পিচকিরি রঙ, আবির সব দু-তিন দিন আগে থেকে জোগাড় করে রেখেছে। রং খেলার জন্য যার যা ছেঁড়া পুরনো জামাকাপড় আছে, তা বের করা হয়েছে বাক্স-প্যাঁটরা ঘেঁটে। পচা ডিম জোগাড় করা, বেলুন-বোম তৈরি করা শেষ। আলু আধখানা করে কেটে তাতে ব্লেড দিয়ে কুঁড়ে কুঁড়ে উল্টো করে “গাধা” লেখা হয়ে গেছে অনেকেরই। দু-চারজন বড়লোকের বাড়িতে আবার দোলের দিন রং দিতে গেলে খাওয়ায়। এবার কে কী খাওয়াবে তাই নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছে।
মন্মথবাবুর নাতি ভুতুম মহা ডানপিটে দুষ্ট ছেলে। সে তার আবিরের মধ্যে চুপি চুপি লঙ্কার গুঁড়ো মিশিয়ে রেখেছে। ডিমের খোলা জোগাড় করে তার মধ্যে ভেঁও আর লাল পেটওয়ালা কাঠপিঁপড়ে ধরে এনে ভরেছে। তারপর আটা গুলে ডিমের খোলা জুড়ে নিয়েছে। যার গায়ে ছুঁড়বে তার গায়ে রং লাগবে না বটে, কিন্তু পিঁপড়ের কামড়ে তিড়িং তিড়িং লাফাবে। তা ছাড়া তার রঙের বালতিতে কাঁচা গোবর মেশানো আছে, আর আছে আলকাতরার কৌটো।
ভুতুমের সঙ্গে রং খেলা দূরে থাকুক, এমনিতেই কেউ খেলতে চায় না। তার মতো দুষ্টু ছেলে গঞ্জে নেই। শুধু পরান নামে একটি ছেলে আছে, যে ভুতুমের মতো অতটা না হলেও বেশ দুষ্টু। সেই পরান হল ভুতুমের প্রাণের বন্ধু। ভুতুম কিন্তু পরানকেও ছাড়ে না। একবার তার জামার পকেটে খুঁয়োপোকা ছেড়ে দিয়েছিল।
বুরুনের এবার রং খেলা বারণ ছিল। তার বাবা বলে দিয়েছেন, “সামনের বছর অল সাবজেক্টে ভালভাবে পাশ করলে আর অঙ্কে লেটার পেলে আবার নরম্যাল লাইফ ফিরে পাবে।”
বুরুনের বাবা ইস্কুলে প্রায়ই খোঁজখবর করে বুরুনের কতটা উন্নতি বা অবনতি হচ্ছে তা জেনে নেন। মাস্টারমশাইরা একবাক্যে বলেন, বুরুনের উন্নতি অসাধারণ। সে শুধু ফাঁইনালে ফাস্টই হবে না, আরো অনেক কিছু করবে। যেমন, অলিম্পিক থেকে অন্তত বারোটা সোনার মেডেল আনবে, ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড ভাঙবে, ফুটবলে গোষ্ঠ পালকে ছাড়াবে।