“কী রকম?”
“ওঃ সে আর বোলো না। হাবু গুণ্ডা ভূতের মন্ত্র জানত। তাই দিয়ে আমাদের বশ করে করে খুব খাটাত। সর্ষে আর ঝাটা দিয়ে পেটাতও খুব। কেন বলো তো, তার কথা জিগ্যেস করছ?”
“সে যদি আবার এখানে আসে, তবে কী হবে?”
“আসবে? ও বাবা, তবে গেছি।”
“তোমরা ওকে খুব ভয় খাও নাকি?”
“তাকে সবাই ভয় খায়। আমাদের যে কী নাকাল করত একসময়ে।”
বুরুন গম্ভীর হয়ে বলে, “আমি একটা কথা স্পষ্ট জানতে চাই। হাবু এখানে এলে তুমি তাকে বেশি খাতির করবে, না আমাকে?”
নিধিরামও গম্ভীর হয়ে বলে, “দেখ বুরুন, তুমি বাচ্চা ছেলে বলে নিতান্ত মায়ায় পড়ে তোমার কাজকর্ম করে দিই। খাতিরও দেখাই। কিন্তু হাবুর হল অন্য কথা। তাকে আমরা কেউ ভালবাসি না বটে, দু’চক্ষে দেখতেও পারি না, কিন্তু তার হল মন্ত্রের জোর। মন্ত্রের কাছে তো আর চালাকি চলে না। সে ঘাড় ধরে আমাদের দিয়ে চাকরবাকরের কাজ করিয়ে নেবে। তাই সে যদি আসে, তবে সাফ বলে দিচ্ছি যে, আমাদের আর তোমার পক্ষ নেওয়া সম্ভব হবে না।”
“বটে?”
“হ্যাঁ। কী করব বলো, আমরা মন্ত্রের বশ।”
বুরুন খুব চিন্তিত হয়ে চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “তখন ডাকলেও আসবে না?”
নিধিরাম মাথা নেড়ে বলে, “আসব না বলছি না। তবে সে সময়ে যদি হাবু কোনো কাজে লাগিয়ে দেয়, তবে আসা সম্ভব নয়। আগে হাবুর কাজ তারপর অন্য কথা।”
“হাবু যদি তোমাকে হুকুম করে–যাও গিয়ে বুরুনের মাথাটা ছিঁড়ে আনন, তাহলে আমার মাথা সত্যিই ছিঁড়ে নেবে?”
নিধিরাম যদিও ভূত, তবু এখন তারও কপালে ঘাম দেখা দিল। অস্বস্তির সঙ্গে বলল, “ওসব অলুক্ষণে কথা থাক। বলতে
নেই।”
“যদি হাবু অমন কথা বলেই তবে কী করবে?” নিধিরাম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি বুরুন, কী আর বলব! তবে হাবুর যদি হুকুম হয়, তবে নিজের মাথা ছিঁড়তেও আমরা বাধ্য।”
৭. দোলের দিনটা এগিয়ে এল
দোলের দিনটা এগিয়ে এল যেন ঘোড়ায় চেপে।
হাবু গুণ্ডা যে ছাড়া পাবে, সে-খবর পাঁচকান হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কারো আর জানতে বাকি নেই।
হাবু যত পাজিই হোক, এ শহরে কিছু লোক আছে যারা হাবুর পরম ভক্ত। তারা মনে করে-হাবুর যে সব অলৌকিক শক্তি দেখা গেছে, সেরকমটা শুধু বড় বড় মহাপুরুষদের থাকে। কাজেই হাবু চুরি-ডাকাতি যাই করুক, এসব লোকদের কাছে সে সাক্ষাৎ ভগবানের ছোট ভাই।
এইরকমই একজন হল পাঁচকড়ি আঢ্য। একসময়ে সে ‘হাবু ওস্তাদের পাঁচালি’ নামে একখানা চটি-বইও বের করেছিল। তাতে ছিল, “প্রথমে বন্দনা করি দেব মহেশ্বর। তার পরেতে বন্দি আমি সর্ব চরাচর ॥ বড় সুখে পূজি আমি বাগদেবীর চরণ। মাতাপিতার চরণে দেই সর্ব প্রাণমন ॥ উত্তরেতে হিমালয় দক্ষিণেতে বন। তার মধ্যে কত গ্রাম গঞ্জ অগণন ॥ গঞ্জের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল ভ্যাটাগুড়ি ধাম। যেথায় বসতি করেন হাবু পুণ্যবান ॥“
এরপর পাঁচালিতে পাঁচকড়ি আরও লিখেছিল, “গুণাকর হাবুর গুণের নাই শেষ। পলকে মনুষ্যে ধরি করি দেয় মেষ ॥ ব্যাঘ্র বাহন আর ভূতপ্রেতের সঙ্গ। নিশি দারোগা ভাগে রণে দিয়া ভঙ্গ। অয়স্কান্ত বীরত্ব দেখাতে এসেছিল। হাবু ওস্তাদ কৌশলে তারেও তাড়াইল ॥ অবশেষে হেলেদুলে আসিল গদাই। গুণাকরের কোপে শেষে তারও রক্ষা নাই।“
একসময়ে এই পাঁচালি হাটে-বাজারে বয়ে ফিরত পাঁচকড়ি। গদাই দারোগার হাতে হাবু জব্দ হওয়ার পর সে কিছু মিইয়ে যায়।
বহুদিন বাদে আবার হাবু ফিরে আসছে শুনে তার একগাল হাসি দেখা গেল। রাম কবিরাজের সঙ্গে একদিন দেখা করে বলল, “কবরেজমশাই, শুনেছেন নাকি! হাবু দেবতা আবার ফিরে আসছেন। যারা তাঁকে হাজতে পাঠিয়েছিল, এবার তারা ঠ্যালা বুঝবে, কী বলেন ঠাকুর?”
রাম কবিরাজের সঙ্গে হাবু কী জানি কেন কোনোদিন তেমন ঝামেলা করেনি। কিন্তু কবিরাজমশাই নিজে গিয়ে যখন হাবুর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিলেন, তখন হাবু আদালতেই বলে উঠেছিল, “কাজটা ভাল করলেন না রামদা।”
কথাটা কবিরাজমশাইয়ের মনে আছে। তিনি তেতো মুখ করে পাঁচকড়িকে বললেন, “মানুষকে খামোকা দেবতা বানাচ্ছ কেন? হাবু আর যাই হোক, মানুষই বটে।”
পাঁচকড়ি জিভ কেটে বলে, “ছি ছি, ওকথা বললে পাপ হয়। তাঁর ক্ষমতা স্বয়ং ভগবানের মতো।”
“তাই যদি হবে তো জেল থেকে বেরোতে পারল না কেন মন্ত্রের গুণে?”
“সে তার লীলা। আমি একবার হাজতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। গিয়ে কী দেখলাম জানেন? তাঁর কপালে সিঁদুরের ত্রিশূল, অ্যাই বড় জটা হয়েছে চুলে, চোখ রক্তবর্ণ। আর সেপাই থেকে শুরু করে জেলার সাহেব পর্যন্ত দিনরাত তাঁর সামনে হাত জোড় করে আছেন। শয়ে-শয়ে লোক এসে তাঁর . ভোগের জন্য মণ্ডা মেঠাই, তরিতরকারি, মাছ-মাংস দিয়ে যায়। জেলের সবাই তাঁর প্রসাদ পায়। আমাকে বললেন, “ওরে পাঁচকড়ি, হাজতে ক’দিন থেকে একটু চিত্তশুদ্ধি করছি।”
“ভগবানেরও তাহলে চিত্তশুদ্ধির দরকার হয় বলছ?”
পাঁচকড়ি রেগে গিয়ে বলে, “অবিশ্বাস করছেন? এই বলে রাখছি কবিরাজমশাই, আপনারা কেউ নিস্তার পাবেন না।”
পাঁচকড়ি বিদায় হলে রাম কবিরাজ নিজের মনে খানিক চিন্তা করলেন। তারপর বোধহয় থানামুখো রওনা দিলেন।
থানায় নতুন দারোগা এসেছে। অল্পবয়সী ছোঁকরা, কথায়-কথায় ফটাফট ইংরিজি বলে ফেলে। ছোঁকরা খুব একটা খারাপ মানুষ নয়, তবে কিনা কাজেকর্মে এখনো তেমন পোক্ত হয়ে ওঠেনি।