বুরুন বলল, দাদু, তোমার কি মনটা খারাপ? আমাকে বলল, আমি সব ঠিক করে দেব।”
রাম কবিরাজ খুব চিন্তিত মুখ করে বুরুনের দিকে চেয়ে থাকেন একটু। তারপর মাথা নেড়ে বলেন, “বিপদ বলে বিপদ! কিন্তু আমার নিজের জন্য তো ভাবি না দাদা। বুড়ো হয়েছি, কাজেই মরতে ভয় পাই না! তবে কিনা একটু দুষ্টু লোক এসে সারা শহরটাকেই নষ্ট করে দেবে!”
“দুষ্টু লোক! সে কে?” বুরুন অবাক হয়ে বলে।
“আছে একজন।”
“সে এসে কী করবে?”
“কী করবে তার কি কিছু ঠিক আছে দাদা! তাই আমি ভাবছি, সময় থাকতেই তোমাকে খানিকটা বিদ্যা শিখিয়ে যাই। আর এ বিদ্যা শুধু শিখলেই হবে না, আবিষ্কারকও হতে হয়, উদ্ভাবকও হতে হয়। আয়ুর্বেদে যা আছে, তার বাইরেও আমি অনেক ওষুধ তৈরি করেছি। এ তো গেল একটা দিক। আবার ভাল চিকিৎসক হতে গেলে শুধু রোগ আর ওষুধ চিনলেই হবে না, পয়সার ধান্দা থাকলেও হবে না। রুগি তোমার কথামতো ওষুধ খায় কিনা দেখতে হবে, পথ্য দেখতে হবে, রুগিকে আপনজনের মতো ভালবাসতে হবে। ভালবাসাই চিকিৎসার মূল কথা। স্নেহ, মমতা, দরদ না থাকলে ভাল চিকিৎসা হয় না। আরো আছে, কোন লক্ষণ দেখে কোন রুগিকে কী ওষুধ দিলে, আর তার ফলাফল কী হল, এসব লিখে রাখতে হয় আলাদা খাতায়। মাঝে-মাঝে খাতাখানা খুলে দেখতে হয়। তাতে কিছু ভুল হয় না। অতীতে যদি কোনো ভুল চিকিৎসা করে থাকে, তবে তা শুধরে নিতে পারবে, আর ভুল করবে না। আমার এরকম কুড়ি-একুশখানা খাতা আছে, সেগুলো ছেপে বই বার করলে মানুষের উপকার হবে। কিন্তু আমার আয়ুতে বোধহয় আর অত কাজ কুলোবে না। সেই খাতাগুলো তোমাকে সব দিয়ে যাব।”
বুরুনের মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। দাদু এমনভাবে কথা বলছেন, যেন তাঁর আর বেশিদিন নয়।
একটু বেলায় দাদু চাকর সঙ্গে নিয়ে গোঁসাইবাগানের দিকে গাছপালার সন্ধানে গেলেন। বুরুন সেই ফাঁকে দাদুর ঘরে গিয়ে ঢুকল।
বুরুনের মন খারাপ থাকলেই সে গিয়ে দাদুর ঘর থেকে চুরি করে চ্যবনপ্রাশ খায়। দাদুর চ্যবনপ্রাশ একদম আচারের মতো খেতে।
ঘরের মধ্যে কবিরাজী ওষুধের একটা সুন্দর মিষ্টি গন্ধ। এই ঝাঁঝালো সুন্দর গন্ধটা বুরুনের দারুণ ভাল লাগে। আর এই জন্যই তার মাঝে-মাঝে কবিরাজ হতে ইচ্ছে করে।
চ্যবনপ্রাশের বয়াম থেকে এক কোষ তুলে চাটতে চাটতে বুরুন গিয়ে দাদুর আরাম-কেদারায় বসে। আরাম-কেদারায় দাদুর মাথার তিল তেলের গন্ধ লেগে আছে। বেশ লাগে।
হঠাৎ একটু হাওয়া ছাড়ল। ঘরের মধ্যে দাদুর টেবিলের কিছু কাগজপত্র এদিক-ওদিক উড়ে গেল। আর একটা ছোট্ট কাগজ উড়ে এসে পড়ল বুরুনের কোলে।
অন্যমনস্ক বুরুন কাগজটা খুলে দেখে লাল কালিতে লেখা একটা চিঠি। চিঠির ভাষা এরকম : প্রণামান্তে নিবেদনমেতৎ যে মহাশয়, আমাদের পরম পূজনীয় সদার হাবু মহারাজকে জব্দ করিবার নিমিত্ত আপনি যে সব দুষ্কার্য ও ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন, তাহা আমরা বিস্মৃত হই নাই। হাবু মহারাজ শীঘ্রই সরকারের হেফাজত হইতে খালাস পাইবেন। আমরা মা কালীর নামে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, হাবু মহারাজের অপমানের প্রতিশোধ লইব। আপনার অন্তিম সময় আগত জানিবেন। শীঘ্রই সাক্ষাৎ হইবে বলিয়া দিন গুনিতেছি। নিবেদন ইতি–আপনার দাসানুদাস হাবু মহারাজের অনুচরবৃন্দ।
চিঠিটা পড়ে বুরুন অবাক। এত বিনয় আর নম্রতার সঙ্গে কেউ কাউকে শাসায় নাকি? তার ভারি হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ দাদুর সব হাবভাব আর কথাবাতা মনে পড়ে যাওয়ায় সে বুঝতে পারল চিঠিটা মজার নয়। এলেবেলে চিঠি হলে দাদু অত অন্যরকম হয়ে যেতেন না।
চ্যবনপ্রাশটা খুব তাড়াতাড়ি শেষ করে বুরুন নিজের ঘরে আসে। দরজা বন্ধ করে দিয়ে সে গম্ভীর গলায় ডাকে, “নিধিরাম! ও নিধিদা!”
নিধিরাম কাছে-পিঠে না থাকলেও ক্ষতি নেই। চারদিকে বাতাসে, আনাচে-কানাচে নিধিরামের অসংখ্য চর ঘুরে বেড়ায়। তাদের মধ্যে অনেক নতুন ভূত, আনাড়ি ভূত, ভিতু ভূত, গাড়োল ভূত, পাগল ভূত, সাধু আর চোর ভূত আছে। কিন্তু সকলকেই নিধিরামের বলা আছে যে, বুরুন তাকে ডাকলে তক্ষুনি যেন খবর দেওয়া হয়।
আজও একটা লিকলিকে রোগা ভূত মোটা ডিকশনারির পাতার মধ্যে ঢুকে চ্যাপটা হয়ে ঘুমোচ্ছিল। বুরুনের ডাক শুনে তোক করে যখন বেরিয়ে এল, তখনো তার শরীরটা কাগজের মতো চ্যাপটা হয়ে আছে। ঘুম-চোখে তাড়াতাড়ি একটা নমস্কার করে বলল, “আজ্ঞে উনি একটু মড়া আহার করতে মনসাগুড়ি গেছেন। সেখানে মড়ক লেগেছে কিনা।”
“মড়া আহার করতে? এ-” ঘেন্নায় বুরুন ঠোঁট বাঁকায়।
রোগা ভূত একগাল হেসে বলে, “যখন ভূত হবেন, তখন আর আপনি অমন কথা বলবেন না। সে এমন ভাল খেতে যে, পোলাও কালিয়া কোথায় লাগে!”
বুরুন বিরক্ত হয়ে বলে, “তাকে এক্ষুনি ডাকো। বলো, বিশেষ দরকার।”
লিকলিকে ভূতটা ‘যাচ্ছি’ বলে এক লম্ফে আকাশ পার হয়ে গেল। একটু বাদেই নিধিরাম খড়কে দিয়ে দাঁত খুঁটতে খুটতে। হাজির।
“ডাকলে কেন?”
বুরুন বলল, “আঁচিয়ে এসেছ?”
“ভূতের আবার আঁচানো!”
“যাও, আঁচিয়ে এসো! স্বাস্থ্যবিধি মানো না, সদাচার নেই–তোমার কেমন মানুষ বলো তো নিধিদা?”
লজ্জা পেয়ে নিধিরাম আঁচিয়ে আসে। বুরুন জিগ্যেস করে, “হাবু মহারাজ বলে কাউকে চেনেন?”
নিধিরাম চমকে উঠে বলে, “ও বাবা! চিনব না? সে আমাদের কম জ্বালিয়েছে নাকি?”