একশো মিটার, দুশো মিটার, আটশো মিটার দৌড়, হার্ডল রেস, হাই জাম্প, লং জাম্প, লোহার বল ছোঁড়া–কোটায় বুরুন সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড না করল? শেষে অন্য সব কম্পিটিটাররা মাঠ থেকে পালাতে লাগল চুপিসাড়ে। লোকে বলাবলি করতে লাগল—“এ তো দেখছি সেই হাবু ওস্তাদের ভুতুড়ে কাণ্ড সব। নইলে ঐটুকু পুঁচকে ছেলে অত জোরে দৌড়তে বা অত উঁচুতে-দূরে লাফাতে পারে নাকি?”
স্পোর্টসের পর বুরুন বাড়ি ফিরল ছেলেদের কাঁধে চড়ে, সঙ্গে প্রাইজের বোঝা। দাদু সব দেখেশুনে বললেন–”হবে না! এ পাঁচন যে আমার নিজের আবিষ্কার! ভেলুদের ডাক্তারী শাস্ত্র ঘেঁটে মরলেও এসব নিদান পাবে না।”
৬. বুরুনের কাজকর্ম
বুরুনের আজকাল কাজকর্ম বড্ড বেড়েছে। সকালে উঠে ঘর ঝটাতে হয়, ন্যাতা দিয়ে মেঝে মুছতে হয়, নিজের পড়ার টেবিল নিজেকে গোছাতে হয়, কুয়ো থেকে স্নানের জল তুলে নিতে হয়, খাওয়ার পর নিজের বাসন মেজে নিতে হয়, সপ্তাহে দু’দিন নিজের জামাকাপড়, বিছানার চাঁদর আর বালিশের ওয়ার কাঁচতে হয়, নিজের জুতো পালিশ করে নিতে হয়, মশারি টাঙাতে হয়। হাজারো কাজ। ভেলু ডাক্তারের হুকুমে তার কাজে সাহায্য করা সবাই বন্ধ করে দিয়েছে। অপমান আরো আছে। অঙ্কে ফেল করায় তার বিছানায় আর তোশক পাতা হয় না। চৌকির ওপর শতরঞ্চি আর চাঁদর পেতে শোওয়া। পায়ে জুতো পরে বটে, কিন্তু মোজা বারণ, রঙচঙে জামাকাপড় পরা বারণ।
প্রথম প্রথম বুরুনের এতে খুব কষ্ট হত। অভিমানে চোখে জলও এসে যেত। রাতে একা শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত।
কিন্তু আজকাল তার কষ্ট আর নেই। ঘুম থেকে খুব ভোর রাতেই উঠে পড়ে সে। নিধিরামই ডেকে দেয়। উঠে দেখতে পায়, নিধিরাম ঘরদোর সাফ করে পড়ার টেবিল গুছিয়ে রেখেছে। স্নানের সময় যখন বুরুন জল তোলে, তখন আসলে তাকে ভারী বালতি টেনে তুলতে হয় না, দড়িটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, বালতি আপনা থেকে উঠে আসে ওপরে। বাসন মাজতেও তার কোনো কষ্ট নেই, কুয়োপাড়ে গিয়ে এঁটো বাসন রাখতে না রাখতেই মাজা-ধোয়া হয়ে যায়। মশারি আপনা থেকেই টাঙানো, গোঁজা হয়ে যায়। রাতে শক্ত চৌকিতে শুতে কষ্ট হয় বলে তারও ব্যবস্থা হয়েছে। খুব নরম একটা তোশক কোত্থেকে বিছানায় চালান হয়ে যায় রাতে, আবার সকাল হতেই সেটা লোপাট।
পড়াশুনোর কষ্টও খুব বেশি নেই আজকাল। পড়ে হবে কী? ক্লাসে যত শক্ত প্রশ্নই তাকে করা হোক না কেন, নিধিরাম ঠিক কানে কানে উত্তর বলে দেয়।
বুরুন আজকাল ভারি আয়েসের জীবন কাটাচ্ছে।
তবে কিনা নিধিরাম যে এত খাতির করছে, তারও কারণ আছে।
প্রায় দিনই রাত্রিবেলা নিধিরাম এসে বিছানার ধার ঘেঁষে মেঝেয় বসে ঘ্যানঘ্যান করে বলে, “বুঝলে বুরুন, তুমি দেখছি মহা চালিয়াত ছেলে, কথা দিয়ে কথা রাখো না।”
বুরুন ঘুম-চোখে হাই তুলে বলে, “এখন ঘুমোব, তুমি কেটে পড়ো তো!”
“আহা, ঘুমোবে তো ঠিকই। কিন্তু আমার যে ঘুম কেড়ে নিয়েছ। জানো তো, সেই যে গোঁসাইবাগানে আমাকে হেনস্থা করেছিলে, তারপর থেকে আর ভূতের সমাজে আমার মুখ দেখানোর জো নেই। স্বয়ং গোঁসাইবাবা আমাকে সাফ বলে দিয়েছে, যদি বুরুন কোনোদিন তোকে একটু ভয় খায়, তবেই
আবার সমাজে তোর জল চলবে। নইলে খড়ম পেটা করে। মামদোদের রাজ্যে তাড়িয়ে দিয়ে আসব।”
“তা আমি করব কী?” নিধিরাম অভিমানভরে বলে, “তোমার জন্য কত কী করছি, ৬২
আর তুমি এটুকু আমার জন্য করতে পারবে না?”
“আমার যে তোমাকে ভয় লাগে না, নিধিদা!”
“চেষ্টা তো করতে পারো।”
“দূর! তোমাকে ভয় খাওয়ার কথা ভাবলেই হাসি পায় যে!”
নিধিরাম আঁশটে মুখ করে চলে যায়। তবে দিনরাত ঘ্যানঘ্যান করতেও সে ছাড়ে না।
দাদু আজকাল কথাবার্তা খুব বলেন না, দিনরাত তাঁর গাছ-গাছড়া নিয়ে নানা ভাবনা-চিন্তা। নানারকম নতুন নতুন অরিষ্ট, পাঁচন, চূর্ণ তৈরি করছেন। দিনরাত বনে-জঙ্গলে ঘুরে মূল, ছাল, পাতা সংগ্রহ করছেন। হিরে, মুক্তো, সোনা পুড়িয়ে ভস্ম তৈরি করছেন। মৃগনাভির সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছেন, এসব বাতিক তাঁর বরাবরই ছিল। কিন্তু ইদানীং যেন বড় বেশি চিন্তিত দেখাছে তাঁকে।
রবিবার দাদু বুরুনকে ডেকে বললেন, “তোমার তো সব দিক দিয়েই প্রবল উন্নতি হচ্ছে দাদা! লক্ষ করছি, আমি না ডাকতেই তুমি ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে পড়ো, নিখুঁতভাবে সব কাজ করছ ঘড়ির কাঁটা ধরে।”
বুরুন লাজুক ভাব করে মাথা নুইয়ে রইল।
দাদু কাছে টেনে এক হাতে বুকে চেপে ধরে, অন্য হাতে মাথায় বিলি কেটে বললেন, “খুব ভাল, খুব ভাল।”
দাদু অনেকক্ষণ তাকে এইভাবে বুকের কাছে ধরে থেকে খুব আস্তে করে বললেন, “দেখ দাদু, বুড়ো হয়েছি, কবে মরেটরে যাই। তাই ভাবছি, আমার যা-কিছু বিদ্যে, সব এখন থেকেই তোমাকে কিছু কিছু শেখাই।”
এমনিতে দাদুর সঙ্গে বুরুনের সম্পর্ক খুবই ভাল, কিন্তু তা বলে দাদু কখনো এরকমভাবে বুরুনকে আদর করেন না। তাই দাদুর
মধ্যে একটা কেমন অসহায় ভাব টের পেয়ে বুরুন অবাক। তার দাদু রাম কবিরাজ কখনো কাউকে ভয় খান না, কারো পরোয়াও করেন না। কিন্তু এখন যেন বুরুন টের পাচ্ছিল যে, দাদু ঠিক আগেকার দাদু আর নেই।
বুরুন নিজে ভারি দুষ্টু ছেলে ছিল বরাবর। অঙ্কে ফেল করার পর থেকেই সে কেমন একটু মুষড়ে পড়েছে। তাই কারো মন খারাপ থাকলে সে টপ করে সেটা টের পেয়ে যায়। তার নিজের যেমন পরিবর্তন হয়েছে, তার দাদুরও তেমনি একটা কিছু পরিবর্তন হয়েছে।