বুরুনের একটু লজ্জা লজ্জা করছে বটে। কিন্তু সে করবে কী?
সতেরোটা ওভার বাউন্ডারি মেরে একশো দুইয়ের পরও বুরুনকে আবার ধুন্ধুমার ব্যাটের চমক দেখাতে হল। দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করতে বুরুন সময় নিল পঁচিশ মিনিট, আবার সতেরোটা ছক্কা মেরে। আউট হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
খুঁতখুঁতে গেম টিচার পর্যন্ত বললেন, “ব্র্যাডমানেরও এরকম রেকর্ড নেই। এ তো ক্রিকেট ইতিহাস পাল্টে দেবে।”
ভাল ছেলেরা আড়াইশোতে দান ছাড়ার পর ফেল করারা ব্যাট করতে এল। বুরুনের হাতে বল। তার কানে কানে নিধিরাম বলল, “চিন্তা নেই।”
তা চিন্তা ছিল না ঠিকই। ফেল করা ছেলেরা ছয় রানে অল ডাউন। বুরুন দুই ওভারে মোট দশটা বল করেছিল, দ্বিতীয় ওভারে চারটের বেশি বল করার দরকারই হয়নি তার। প্রতি বলে একটা করে উইকেট পড়েছে। ট্রিপল হ্যাঁট্রিক সমেত তার বোলিংয়ের হিসেব ১.৪ ওভার, ২ মেডেন ০ রান, ১০ উইকেট। তার দুই ওভারের মাঝখানে একজন আনাড়ি ছেলে এক ওভার বল করেছিল, তাইতে ফেল করারা ছয় রান নেয়।
গেম স্যার বললেন, “ওয়ার্লড রেকর্ড।” কিন্তু তাঁর বিস্ময়ের এই সবে শুরু। এ তো গেল ক্রিকেটের বৃত্তান্ত।
.
ঠিক পনেরো দিন পরে স্কুলের বার্ষিক স্পোর্টস। খুব তোড়াজোড় করে স্পোর্টস হয় স্কুলে। কারণ স্কুল স্পোর্টসের পরই জেলা স্পোর্টসে স্কুল থেকে ছাত্রদের বাছাই করে পাঠানো হয়। এ-স্কুলের পড়াশুনোয় যেমন, খেলাধুলোতেও তেমনই সুনাম।
বুরুন প্রতি বছরই স্পোর্টসে একটি-দুটি প্রাইজ পায়। বলার মতো তেমন কিছু নয় অবশ্য। তার গ্রুপে সে হাইজাম্পে গতবারও থার্ড প্রাইজ পেয়েছিল, আর দুশো গজ দৌড়ে সেকেণ্ডও হয়েছিল। কিন্তু স্কুলের নামকরা ভাল অ্যাথলেটদের তুলনায় সেগুলো কিছুই না।
স্পোর্টসের দিন দশেক আগে হিট হচ্ছে। কতকগুলো বিষয় গ্রুপের মধ্যে সীমাবদ্ধ, আর গোটা দুই-তিন বিষয় আছে, যা সকলের জন্য। বুরুন তার গ্রুপের সব রকম দৌড় আর লাফে নাম দিল। তাছাড়া দশ হাজার মিটার দৌড়, সাইকেল রেস আর লোহার ভারী গোলা ছোঁড়ার যে বিষয়গুলি সকলের জন্য, তাতেও নাম লেখাল। ক্রিকেটে তার এলেম দেখার পর স্পোর্টসে এতগুলো বিষয়ে নাম লেখানোতে কেউ ডু কোঁচকাল না, বুরুনের ভিতর কী আছে তা তো কেউ জানে না।
হিট শুরু হওয়ার দিনই নিধিরাম উৎসাহের চোটে এমন কেলেঙ্কারি করে বসল যে, বুরুন লজ্জায় মরে যায় আর কী!
প্রথম বিষয় ছিল একশো মিটার দৌড়। গেম স্যার স্টপ ওয়াচ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট গেম স্যার হুইসিল বাজিয়ে দৌড় শুরুর সংকেত দেওয়ামাত্র বুরুনের মনে হল, একটা ঝড়ের বাতাস তাকে প্রবল বিক্রমে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এমন হল যে, বুরুনের পা প্রায় মাটিতেই ঠেকল না।
দৌড়ের শেষে গেম স্যার মাঠে বসে পড়ে নিজের মাথা চেপে ধরে বললেন, “একশো মিটার মাত্র আট সেকেন্ডে! উঃ, আমি অজ্ঞান হয়ে যাব।”
সত্যিই অজ্ঞান হয়ে যেতেন, বুরুন গিয়ে তাড়াতাড়ি তাঁকে ধরে বলল, “না স্যার, আট সেকেন্ডে নিশ্চয়ই নয়। স্টপ ওয়াচটা বোধহয় খারাপ।”
গেম স্যার ভ্যাবলা দুটো চোখে চেয়ে বললেন, “বলছ?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার?”
“ঠিক তো?”
“ঠিকই। অত জোরে আমি দৌড়োইনি।”
গেম স্যার উঠে বললেন, “দৌড়োলে মুশকিল হত। কারণ, ওয়ার্ল্ড রেকর্ডও ওর চেয়ে অনেক বেশি কিনা।”
হাই জাম্পের আগে বুরুন আড়ালে গিয়ে ধমক দিয়ে বলল, “নিধিদা, এসব কী হচ্ছে বলো তো! বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু গোঁসাই-সদারকে গিয়ে বলে দেব।”
নিধিরাম ভয় খেয়ে বলল, “তা ওয়ার্লড রেকর্ড-টেকর্ড কি আর জানা আছে! আগে থেকে বলবে তো?”
“আচ্ছা, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এবার সাবধান।” হাই জাম্পে বুরুন চটপট কাঠি পার হতে লাগল বটে, তবে খুব একটা বাড়াবাড়ি করল না। তাতেও অবশ্য কম কিছু হল না, গেম স্যার মেপে দেখলেন, বুরুন শেষ লাফে ছ’ ফুট ডিঙিয়েছে এক চান্সে। গেম স্যারকে খুবই গম্ভীর দেখাচ্ছিল।
লং জাম্পে বুরুন আরো সাবধান হল। মাত্র বাইশ ফুট লাফিয়ে আর লাফাল না।
গেম স্যার তাকে আড়ালে ডেকে খুব উত্তেজিতভাবে বললেন, “শোনো বুরুন, তোমার ভিতর যে কী সাঙ্ঘাতিক ক্ষমতা ভগবান দিয়েছেন, তা তুমি হয়তো টের পাচ্ছ না! আমি বলে দিচ্ছি, তুমি অলিম্পিক থেকে একাই অন্তত এক ডজন সোনার মেডেল নিয়ে আসবে। এখন থেকে তৈরি হও।”
বুরুন খুব লজ্জার হাসি হাসল। সারা মাঠে তাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তাকে দেখবার জন্য ছেলেরা ভিড় করছে। শহরের লোকেও চলে আসছে কাণ্ড কারখানা দেখতে।
স্পোর্টসের দিন দুপুরে মাঠ ভেঙে পড়েছে ভিড়ে। শুধু এ। গঞ্জই নয়, আশেপাশের এলাকা থেকে, এমন কী, জেলা-শহর থেকেও গাড়ি করে লোক এসেছে। সবাই কানাঘুষো শুনেছে, গঞ্জে নাকি এক সাঙ্ঘাতিক স্পোর্টসম্যানের আবির্ভাব হয়েছে।
বুরুনের কাণ্ড শুনে দাদুও অবাক। নাতির এত এলেম তাঁরও জানা ছিল না। তিনি নাতির শক্তিবৃদ্ধির জন্য একটা ভাল পাঁচন তৈরি করে খাইয়ে দিয়েছেন। তাতে বুরুনের গায়ে যথেষ্ট জোর এসে গেছে।
এক দিকে দাদুর বলকারক পাঁচন, অন্য দিকে নিধিরাম। দুইয়ে মিলে সে এক যাচ্ছেতাই কাণ্ড হয়ে গেল স্পোর্টসে।
পোলভল্টে বাঁশে ভর করে আকাশের দিকে উঠে গেল বুরুন, আড় হয়ে থাকা বার-এর অন্তত দশ ফুট উঁচু দিয়ে। মাপজোক করলে বাইশ-তেইশ ফুট দাঁড়াবে। মাঠ ফেটে পড়েছে চিকারে আর উত্তেজনায়।