ভুতুর দুর্দান্ত বলটা এল। বুরুনকে কিছুই করতে হল না। ব্যাটটা কে যেন তার হয়ে চালিয়ে দিল। আর বলটা জেট প্লেনের মতো ছুটে গিয়ে ইস্কুলবাড়ির দোতলার ছাদে পড়ল। ছক্কা।
আনতাবড়ি মার হয়ে গেছে ভেবে কেউ খুব একটা হাততালি দিল না।
কিন্তু পরের বলটা আবার উড়ে গিয়ে মস্ত শিরীষ গাছে একটা পাখির বাসা ভেঙে নিয়ে পড়ল। ছক্কা।
এবার কিছু ক্ষীণ হাততালি, বুরুনদের ক্যাপটেন অনিরুদ্ধ নিজের ঠ্যাঙের ব্যথার জায়গায় হাত বোলাতে বোলাতে মাঠের বাইরে থেকে চেঁচাল, “বুরুন, চালিয়ে যা।”
তা, চালাল বুরুন। তৃতীয় বলটা এমন হাঁকড়াল যে, সেটা গিয়ে ইস্কুলের পাশে পণ্ডিতমশাইয়ের বাড়ির নারকোল গাছের
ডগায় গিয়ে একটা ঝুনো নারকোল সমেত নেমে এল। পণ্ডিতমশাইয়ের বুড়ি পিসি বেরিয়ে এসে চেঁচাতে লাগলেন, “কে রে ডানপিটে বদমাশ। গাছে ঢিল মেরে নারকোল পাড়িস দুকুরবেলা? দাঁড়া, হরকে বলে তিন ঘণ্টা নিলডাউন করিয়ে রাখব?”
পণ্ডিতমশাইয়ের নাম হরপ্রসাদ। পান থেকে চুন খসলেই ছাত্রদের নিলডাউন করিয়ে রাখেন।
পণ্ডিতমশাইয়ের পিসিমা এক হাতে নারকোল অন্য হাতে বলটা কুড়িয়ে চেঁচিয়ে বললেন, “ওই দেখ, নারকোলের সঙ্গে একটা বেলও পড়েছে দেখছি, তা এ-বাড়িতে তো বেলগাছ নেই, তবে বেল এল কোত্থেকে?”
হর-স্যারের পিসির হাত থেকে বলটা উদ্ধার করা খুব শক্ত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিলডাউন হওয়ার ভয়ে কেউ এগোতে সাহস পাচ্ছে না। খেলা পণ্ড হওয়ার জোগাড়।
বুরুন ফিসফিস করে বলল, “ও নিধিরাম, যাও না বলটা নিয়ে এসো।”
নিধিরাম বুরুনের কানে কানে বেশ রাগ করে বলে উঠল, “বড় যে নাম ধরে ডাকছ! তোমার চেয়ে বয়সে আমি কত বড় জানো? দুশো বছরের বড়। সেটা খেয়াল রেখো।”
বুরুন ফিক করে হেসে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা। নিধিদা বলে ডাকব তাহলে।”
মুহূর্তের মধ্যে একটা ঘূর্ণি হাওয়া উঠে মাঠ পেরিয়ে হর-পণ্ডিতের বাড়ির দিকে ধেয়ে গেল। স্যারের পিসি কিছু বোঝবার আগেই ঝটকা বাতাসে হাতের বলটা ছিটকে আবার মাঠের মধ্যে চলে এল। স্যারের পিসি চেঁচাতে লাগলেন, “ঐ যাঃ, গেল এমন পাকা বেলটা। কী সুন্দর গন্ধ-ওঠা বেলটা ছিল, ভাবলুম আজ পানা করে হরকে খাওয়াব। বাছার পেটটা ভাল যাচ্ছে না…”
পরের ওভার করতে এল কেষ্ট। তার চেহারা দানবের মতো। বল করে না কামান দাগে তা বোঝা শক্ত। তবে ইস্কুলেরই শুধু নয়, এই জেলার সে-ই সবচেয়ে বিপজ্জনক বোলার। তার বলে হয় স্টাম্প ভাঙে, নয় তো ব্যাটসম্যানের পা, আর এ দুটোতে না লাগলে নিঘাত উইকেটকিপারের পাঁজর ফাটবে। তাই কেষ্ট বল করার সময় সবাই ভারি গম্ভীর হয়ে যায়।
তবে কিনা ইস্কুলের এলেবেলে খেলায় সে ইচ্ছে করেই বেশি জোরে বল করে না। আজও সে প্রথম বলটা বেশ আস্তেই দিল। সেই বলে বুরুনের পার্টনার ব্যাট ছুঁইয়ে একটা রান করল।
কেষ্টর দ্বিতীয় বলটাও বেশ আস্তের ওপর ছিল। তবে কি না তার কাছে আস্তে হলেও বলটা তেমন আস্তে বলে আর কারো মনে হল না। একটা লাল সাপের মতো সেটা ধেয়ে এসেই ছোবল তুলল বুরুনের বুকে।
বুরুনের ব্যাট হেলাভরে ওপরে উঠে এমন লাথি লাগাল সাপটাকে যে, সেটা লেজ গুটিয়ে পাখি হয়ে উড়ে গেল মেঘের দেশে।. তারপর চিৎপাত হয়ে পড়ল পাশের মাঠে, যেখানে বাচ্চা ছেলেরা খেলছে। সে-মাঠেও একটা ছেলে ব্যাট হাঁকড়েছে। তাই বলটা কোন্ দলের তাই নিয়ে একটু গোলযোগ বেধে উঠল।
মার খেয়ে কেষ্ট রেগে যাচ্ছে। তিন নম্বর বলটা সে খুব জোরে না হলেও বেশ জোরে দিল। পিচের ওপর বিদ্যুৎ খেলিয়ে সেটা ছুঁতে এল বুরুনকে। কিন্তু বুরুনের ব্যাট আজ বজ্ৰাদপি কঠোর। বলটাকে এমন ঘাড়ধাক্কা দিল যে, সেটা কাঁচুমাচু হয়ে ফের বাতাসে সাঁতরে মাঠ পার হয়ে, ইস্কুলের দেয়ালের চুনবালি খসাল খানিক। দেয়ালের ভাঙা জায়গাটা আফ্রিকার ম্যাপ হয়ে গেল।
পাঁচ মিনিটে বুরুনের ত্রিশ রান। চারদিকে ফটাফট হাততালি পড়ছে।
কেষ্ট আস্তিন গুটোয়, বুক ভরে দম নেয়। তারপর মাঠের শেষপ্রান্তে গিয়ে তার বল করার দৌড় শুরু করে। তার মানে এবার কেষ্ট তার সবচেয়ে জোরালো বল দেবে।
বুরুন নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে থাকে। কেষ্টর বলটা সে অবশ্য ভাল করে দেখতেও পায় না। কিন্তু ব্যাট যখন বলটার গায়ে লাগল, তখন তার মনে হল, ব্যাটটা বুঝি ভেঙেই যাবে।
সারদাচরণবাবু জমিদার। তাঁর বাড়ির মাথায় একটা পাথরের পরী দিব্যি ডানা মেলে একশো বছর কাটিয়ে দিয়েছে। বজ্জাত বলটা গিয়ে পরীর একটা ডানা ভেঙে তবে থামল।
আবার ছক্কা। কেষ্টর পাঁচ নম্বর বলটা আগেরটার চেয়েও জোর। সেই তেজে বলটা প্রায় অদৃশ্য অবস্থায় কখন যে এসেছে, আর কখন যে ব্যাটটা তাকে বেতিয়েছে তা বুরুন জানে না। তবে এবার সেটা গিয়ে একটা খড়-বোঝাই গরুর গাড়ির খড়ের গাদায় সেঁধিয়ে গেল। বলটা এত মারধর পছন্দ করছিল না বোধ হয়, গা ঢাকা দেওয়ার তালে ছিল।
বহু কষ্টে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে গাড়ি থামিয়ে বলটা উদ্ধার করতে হল। সেই ফাঁকে পাশ-করা ছেলেরা এসে বুরুনকে কাঁধে নিয়ে খানিক ধেই-ধেই করে নেচে নেয়। মাঠের বাইরে গিয়ে তারাই আবার ফেল করা ছাত্রদের বক দেখায়।
বিয়াল্লিশ থেকে একশো দুইয়ে পৌঁছতে লাগল মোটে বারো মিনিট। সর্বসাকুল্যে সাতাশ মিনিটে সে সেঞ্চুরি করেছে এবং এখনো আউট হয়নি। ইতিমধ্যেই তার ব্যাট করার খবর পেয়ে প্রথমে গেম টিচার এবং তারপর হেডস্যার সমেত সব মাস্টারমশাই মাঠের ধারে চলে এসেছেন। শহরের লোজনও খবর পেয়ে চলে আসছে। মাঠের চারধারে তুমুল ভিড় হয়ে গেল দেখতে-না-দেখতে।