সবাই খাতা খুলে খস খস করে কষে ফেলছে।
বুরুনও কষে ফেলল। বেশি সময় লাগেনি তার। মিনিট দেড়েক বড়জোর। খাতা নিয়ে কালীবাবুর কাছে জমা দেবে বলে যখন উঠতে যাচ্ছে, তখন কানের কাছে ফিসফিস করে কে যেন বলল, “আঃ, যাচ্ছেতাই ভুল করলে যে! করালীবাবুর ডাস্টারের বাড়ি খেতে যাচ্ছ নাকি?”
বুরুন প্রথমে ভেবেছিল, ফটিক কথা বলছে। কিন্তু চেয়ে দেখল, ফটিক বেঞ্চের একেবারে ওই প্রান্তে বসে গোয়েন্দা-গল্পের বই পড়ছে চুরি করে।
তবে কে বলল কথাটা? কানের কাছে কে যেন ফিক করে একটু হেসে বলে ওঠে, “ভয় পেলে নাকি?”
বুরুন তৎক্ষণাৎ গম্ভীর হয়ে নিচু স্বরে বলে, “আমি কাউকে ভয় খাই না।”
না-দেখা লোকটা তখন গলার স্বরটা খুব দুঃখের করে বলল, “তুমি দেখছি খুব উদ্ভট ছেলে। যাকগে, কী আর করা! বরং তোমার একটু উপকার করে দিয়ে যাই। দাও খাতাটা, অঙ্কটা কষে দিই।”
বুরুন একটু ইতস্তত করে বলল, “খাতাটা দিলে করালীবাবু দেখতে পাবেন যে!”
“তাহলে তুমি খাতা খুলে পেনসিল ধরে বসে থাকো, আমি তোমার হাত ধরে ধরে লিখিয়ে দিই।”
তাই হল। দশ সেকেন্ডের মধ্যে অঙ্কটা ঠিকঠাক কষে দিয়ে অদৃশ্য নিধিরাম তাকে একটা ঠেলা দিয়ে বলে, “যাও, সবার আগে গিয়ে দেখিয়ে আনো।”
(অঙ্কের উত্তর এখানে দেওয়া হল না। পাঠক-পাঠিকারা সেটা বের করবে।)
বুরুন গিয়ে করালী স্যারকে খাতা দেখাতেই তিনি তার পিঠ চাপড়ে বললেন, “দারুণ!”
আরো কয়েকজন অঙ্কটা তিন মিনিটের মধ্যে ঠিকঠাক কষেছিল, কালী স্যার সকলের পিঠ চাপড়ে দিলেন। করালীবাবু ওইরকমই, খুব সোজা অঙ্কও কেউ করে দিতে পারলে ভীষণ খুশি হয়ে ওঠেন।
পরের অঙ্কটা একটু কঠিন, একটা কিস্তৃত গাড়ির চারটে চাকা চার রকম, একটার ব্যাস তিন ফুট তিন ইঞ্চি, আর একটার তিন ফুট আট ইঞ্চি, তৃতীয়টার চার ফুট দুই ইঞ্চি, চতুর্থটির ব্যাস দুই ফুট এগারো ইঞ্চি, এই কিম্ভুত গাড়িটা যদি পাঁচ মাইল যায় তবে চারটে চাকার কোষ্টা কতবার সম্পূর্ণ এবং কতখানি আংশিক আবর্তিত হবে? করালীবাবু এটার জন্য দশ মিনিট সময় বরাদ্দ করলেন।
সবাই অঙ্ক কষতে ব্যস্ত। কিন্তু বুরুনের সে ভাবনা নেই। সে অঙ্কটা খাতায় টোকামাত্র নিধিরাম তার হাত ধরে বিশ সেকেন্ডের মধ্যে অঙ্কটা কষে একটা ঠেলা দিয়ে বলল, “যাও।”
বুরুনকে খাতা হাতে টেবিলের কাছে আসতে দেখে করালীস্যার হাঁ হয়ে গেলেন। খাতা দেখে আরো তাজ্জব। বললেন, “এটা তোমার আগে থেকে কষা ছিল!”
“আজ্ঞে না স্যার, এই মাত্র করলাম।”
“বটে! তাহলে বলতে হয় তোমার ভাগ্যে স্বর্ণপদক রয়েছে।”
এর পরের অঙ্ক চৌবাচ্চায় জল ঢোকা আর বেরোনো নিয়ে, এটা কষতে বুরুনের লাগল তেরো সেকেন্ডের মতো। করালীবাবু অঙ্কে রাইট দিয়ে বললেন, “তুমি অ্যানুয়েলে অঙ্কে যেন কত পেয়েছিলে! বারো না তেরো কী একটা বোধহয়! না হে, তোমার সেই খাতাটা আবার আমাকে দেখতে হবে।”
করালীস্যারের পর অবনীবাবুর ট্রানস্লেশন ক্লাস। তিনি ইংরিজি করতে দিলেন ‘কুল খাইয়া রমেনের দাঁত টকিয়া গিয়াছে। ভবানী পাঠক তো সোজা পাত্র নয়, সে ভালর ভাল মন্দের যম। এই সেই জনস্থান-মধ্যবর্তী প্রস্রবণ, গিরি, ইহার শিখরদেশ সতত সঞ্চরমাণ জলধরপটল সংযোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় সমাচ্ছন্ন…ইত্যাদি।
সবাই কলম কামড়াচ্ছে।
ঠিক চল্লিশ সেকেন্ড বাদে নিধিরাম বুরুনকে ঠেলে দিয়ে বলল, “যাও, হয়ে গেছে।”
বুরুন গেল। অবনীবাবু খাতা দেখে মাথা চুলকে বললেন, “ইংরিজিতে তুই কাঁচা নোস ঠিকই, কিন্তু এত ভাল ইংরিজি বহুঁকাল কোনো ছাত্রকে লিখতে দেখিনি। বাঃ বাঃ। এরকম চালিয়ে গেলে তুই স্কলারশিপ পাবি যে রে!
বুরুন খুব লজ্জার ভঙ্গিতে মাথা নত করে থাকে।
বছরের শুরু, ক্লাস এখনো পুরোপুরি হয় না, পঞ্চম ঘণ্টার পর ছুটি হয়ে গেল। গেম টিচার দুই সেট ক্রিকেটের সরঞ্জাম বের করে দিলেন।
ইস্কুলের পাশে পেল্লায় মাঠে হই-হই করে ক্রিকেট নামল। এক দিকে নিচু ক্লাসের ছেলেরা পার্টি করে খেলছে। অন্য ধারের টিমটা কিছু অদ্ভুত। এতে ফেল করা ছাত্রদের সঙ্গে পাশ করা ছাত্রদের ম্যাচ, গেম স্যার টিম ঠিক করে দিয়েছেন।
বুরুন অঙ্কে ফেল করলেও ক্লাসে উঠেছে। তাই সে পাশ-করাদের দলে। কিন্তু পাশ-করা ভাল ছেলেরা খেলাধুলোয় তেমন মজবুত নয়। অন্য দিকে ফেল করা ছেলেরা সব সাঙ্ঘাতিক সাঙ্ঘাতিক প্লেয়ার। তারা যেমন দুর্দান্ত ব্যাট করে, তেমনি দুর্ধর্ষ বল। তারা ছোটে, লাফায়, গড়াগড়ি খায় অনায়াসে। তাই আজ খেলার মাঠে পাশ করাদের বড় দুর্দিন।
পাশ করারা ব্যাট করতে নামল টসে জিতে। প্রথম ওভারেই দুজন জখম হয়ে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে বসে পড়ল। দুজন বোন্ড আউট হয়ে গেল। দ্বিতীয় ওভারে আরো একজন আউট, তবে তিনটে রান হল। তৃতীয় ওভারে পর-পর দুজন ক্যাচ দিয়ে ফিরে ৫২
গেল, একজন ভয়ে দান ছাড়ল।
বুরুন ব্যাট ভাল করে না, তবে বল সে ভালই করে। কিন্তু আটজন বসে পড়ায় তাকে ব্যাট করতে নামতেই হয়।
যখন মাঠে নামছে বুরুন, তখন কানের কাছে ফের সেই ফিসফিসানি, “কোনো ভয় নেই, আমি আছি।”
বুরুন গম্ভীর হয়ে বলল, “হুঁ।”
“সেঞ্চুরি করিয়ে দেবো। কিন্তু খোকা, মনে রেখো আমার প্রেস্টিজটা তোমাকে রাখতে হবে।”
“দেখা যাবে।”
বুরুন নেমে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখছিল, ফেল করা হুমদো-হুঁমদো ছেলেরা হাসাহাসি করছে। ফাস্ট বোলার ভুতু তাকে উদ্দেশ করে বলে, “নে, আর দেখতে হবে না। যে পথে এসেছিস, সে পথটাই ভাল করে দেখে রাখ। এক্ষুনি ফিরতে হবে তো।”