কথাটা মিথ্যে নয়। কদিন হল হাবুর মনে হচ্ছে, এ জায়গায় যথেষ্ট রোজগার করা হয়েছে। তাছাড়া গদাই দারোগা লোকটাও তেমন সুবিধের ঠেকছে না। অন্য পাঁচটা দারোগা যেমন ভয় পেত, এ তেমন পায় না। নতুন জায়গায় গেলে রোজগারেরও সুবিধে, আর ভাবনাচিন্তাও কম করতে হবে। এই ভেবে সে স্যাঙাতদের তৈরি থাকতে হুকুম দিল। বলল, “এ জায়গাটা বড় গরম আর শুকনো হয়ে গেছে রে। তৈরি থাকিস সব, হুট করে একদিন গাঁটরি বাঁধতে হবে।”
চলে যাওয়ার আগে হাবু সবচেয়ে মোটা দাঁও মেরে যাওয়ার লোভে সতেরোটা চা বাগানের মালিক টমসন সাহেবের বাচ্চা ছেলেকে চুরি করে লুকিয়ে রাখল। সাহেবকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিল, “এক লক্ষ টাকা আগামী অমাবস্যার রাতে আপনার বাড়ির পিছন দিকের বাগানে ঝুমকো জবাগাছের নীচে একটা পাথর চাপা দিয়ে রেখে দেবেন। নয়তো রাত ভোর হওয়ার আগেই মা কালীর সামনে বলি হিসেবে আপনার ছেলেকে উৎসর্গ করা হবে।”
সাহেবরা সহজে ভয় খায় না বটে, কিন্তু টমসন সাহেবের ব্যাপারটা অন্যরকম। মাত্র এক বছর আগে তাঁর বউ মারা গেছে। মা-হারা তিনটি সন্তানের জন্য তাঁর গভীর মায়া ছিল। তাই ছেলে চুরি যাওয়ার পর রেগে আগুন হয়েও তিনি খুব শক্ত হতে পারলেন না।
কী হয়েছিল তা সবাই সঠিক জানে না। তবে টমসন সাহেবের বাগানে জবাগাছের নীচে এক লক্ষ টাকা রাখা ছিল এবং যথাসময়ে হাবুর কোনো চেলা এসে সেটা নিয়েও যায়।
লোকে আবার অন্য কথাও বলে। বলে যে, হাবুর চেলা এসেছিল ঠিকই, তবে সে আর ফিরে যায়নি, গদাই তকে হাত-পা বেঁধে চালান করে দিয়ে, নিজেই সেই চেলা সেজে হাবুর আস্তানায় গিয়ে ঢুকেছিল।
তারপর এক তুলকালাম কাণ্ড। মুহুর্মুহু বাঘের ডাক, বন্দুকের আওয়াজ, চিৎকার। সব লোক জেগে শুনছে।
পরদিন চাউর হয়ে গেল, হাবু বমাল ধরা পড়েছে। ধরা পড়ার আগে সে নাকি খুব এক হাত লড়েছিল গদাইয়ের সঙ্গে। হয়তো বা অন্য সময় হলে সে গদাইকে গদার মতো ঘুরিয়ে আছাড় দিত। কিন্তু রাম কবিরাজের পাঁচন খেয়ে-খেয়ে তখন গদাইয়ের তেজই আলাদা।
৫. করালী স্যারের অঙ্কের ক্লাস
করালী স্যারের অঙ্কের ক্লাস। ছাত্ররা এখন আর অঙ্ককে অঙ্ক বলে না, বলে ভয়াঙ্ক। ভয় আর অঙ্ক সন্ধি করে এই নতুন শব্দটা তারা বানিয়ে নিয়েছে।
তা ভয়াঙ্কই বটে। ক্লাসে যেসব অঙ্ক করানোর কথা, সেসব তো আছেই, তাছাড়াও করালীবাবু ছাত্রদের অঙ্কে পোক্ত করে তুলবার জন্য বাইরের বই থেকে যত রকম ম্যাথমেটিক্যাল প্রবলেম নিয়ে এসে ছাত্রদের দেন।
আজ করালীবাবু ক্লাসে এসে হাসি-হাসি মুখে বললেন, “মাই লিটল ফ্রেন্ডস, কাল ভোর রাতে আমি স্বপ্নে একটা অঙ্ক পেয়েছি, খুব ইন্টারেস্টিং।”
ছেলেরা নড়ে-চড়ে বসল, করালীবাবু স্বপ্নে অঙ্ক পান, এটা খুব বেশি নতুন কথা নয়। এর আগেও বহুবার তিনি স্বপ্নে অঙ্ক পেয়েছেন। তবে কিনা করালীবাবুর কাছে যেটা সুখ-স্বপ্ন, সেটাই তাঁর ছাত্রদের কাছে দারুণ দুঃস্বপ্ন!
করালীবাবু বললেন, “বুঝলে, ভোররাতে দেখি আমি একটা জুতোর দোকানের কর্মচারী হয়ে কাজ করছি।”
বুরুন লাস্ট বেঞ্চে বসে ছিল। আজকাল সে এখানেই বসে। অঙ্কে ফেল করার পর থেকে সে ভাল ছেলেদের সঙ্গে ফাস্ট বেঞ্চে বসতে লজ্জা পায়। পিছনের বেঞ্চে ছাত্র কম, বুরুনের পাশে আর-একজন মাত্র বসে আছে, সে হল ফটিক। কালীবাবুর কথা শুনে ফটিক বিড়বিড় করে বলল, “খুব ভাল হত তাহলে। বাঁচতুম।”
বুরুন জবাব দিল না, আজকাল সব সময়ে তার মন খারাপ থাকে।
করালীস্যার হেসে বললেন, “বুঝলে সবাই! জুতোর দোকানের কর্মচারী। তা আমার বেশ ভালই লাগছিল। দোকানের মালিকটি ভালমানুষ গোছের, হিসেব-টিসেব বোঝে না। লাভ-ক্ষতি বা লেনদেনে হিসেবের গোলমাল বুঝলেই আমাকে ডেকে জিগ্যেস করে, আচ্ছা কালীবাবু, হিসেবটা কী হবে বলে দিন তো! যাই হোক, কাজটা আমার বেশ ভালই লাগছিল। খদ্দের এলে জুতো বের করছি, পরাচ্ছি, পছন্দ হল বা ফিট করল কিনা দেখছি, মাঝে-মাঝে মুখে-মুখে অঙ্ক কষে মালিককে হিসেব বুঝিয়ে দিচ্ছি। বেশ লাগছে। এমন সময়ে এক খদ্দের এলেন। একজোড়া জুতো তাঁর পছন্দ হয়ে গেল। দরদস্তুর করে কুড়ি টাকায় রফা হল। তিনি মালিককে একশো টাকার একটা নোট দিলেন। মালিকের ক্যাশ বাক্সে তখন অত টাকা ছিল না, আমাকে নোটটা দিয়ে বললেন, করালীবাবু পাশের দোকান থেকে টাকাটা ভাঙিয়ে আনুন তো।… লিটল ফ্রেন্ডস, তোমরা খুব মন দিয়ে ট্রানজ্যাকশানগুলো লক্ষ করো। …হ্যাঁ, তারপর আমি তো পাশের দোকানে গিয়ে একশো টাকার নোট ভাঙিয়ে এনে মালিককে দিলাম। মালিক কুড়ি টাকা রেখে খদ্দেরকে আশি টাকা ফেরত দিলেন। খদ্দের জুতোর বাক্স বগলে নিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু একটু বাদেই পাশের দোকানের মালিক এসে সেই একশো টাকার নোটটা আমার মালিককে ফেরত দিয়ে বললেন, ‘মশাই, এ নোর্টটা জাল, এটা বদলে দিন।‘ মালিক নোটটা ভাল করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বললেন, ‘তাই তো, বড্ড ঠকিয়ে গেছে দেখছি!’ এই বলে মালিক ক্যাশ বাক্স থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে একশো টাকা নিয়ে দিয়ে দিলেন। পাশের দোকানের লোকটা চলে গেল। তারপর মালিক অনেকক্ষণ অঙ্ক কষে বের করার চেষ্টা করলেন তাঁর কত ক্ষতি হল। কিন্তু লোকটা ভারি বোকাসোকা ভালমানুষ গোছের, তাই কিছুতেই হিসেব মেলে না। একবার উ-হুঁ-হুঁ করে উঠে বলেন, ও বাবা, আমার দুশো টাকা লস হয়েছে। আমি জিগ্যেস করলাম, কি করে? তিনি বললেন, খদ্দেরকে আশি টাকা দিলাম, দোকানদারকে একশ টাকা, আর এক জোড়া জুতো–দুশো দাঁড়াচ্ছে। আবার বলেন, না না, মোট আশি টাকা গচ্চা গেছে দেখছি..ঐ যাঃ, হিসেবের ভুল, একশো টাকা আর কুড়ি টাকার জুতো, মোট একশো কুড়ি টাকা গেল। আবার বলেন, না, না, এক জোড়া জুতো ছাড়া আর তো আমার কিছুই যায়নি…না না, আবার সেই ভুল। দোকানদারকে যে একশো টাকা দিলুম।…যাই হোক, শেষ পর্যন্ত তিনি আমার দিকে করুণ চোখে চেয়ে বললেন, করালীবাবু, আমার কত দণ্ড গেল তা একটু হিসেব করে বলে দেবেন?…মাই ফ্রেন্ডস, আজকের প্রথম অঙ্ক এটাই। ভেরি সিম্পল অ্যারিথমেটিক। বলতে গেলে ক্লাস টুর অঙ্ক। জলবৎ তরল। তিন মিনিট সময় দিচ্ছি, কষে ফেল।”