- বইয়ের নামঃ গোঁসাইবাগানের ভূত
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. কিছু ভুতুড়ে কথা
গোঁসাইবাগানের ভূত – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
কিছু ভুতুড়ে কথা
এই উপন্যাসটি শারদীয় ‘আনন্দমেলা’-য় প্রথম বেরোনোর পরই অনেকে প্রশ্ন তুলেছিল, রামনামকে ভূতের যদি এতই ভয় তবে ভূতের নিজের নাম কেন নিধিরাম? ভারি শক্ত প্রশ্ন। মাথাটাকে চুলকে আমি তখন বোঝালাম, নামের ‘রাম’ আর ‘রামনাম’ তো এক নয়! নিধিরামের যে রাম, তার সঙ্গে দশরথের বড় ছেলের সম্পর্ক নেই কোনো। তাছাড়া সাপের বিষ কি সাপকে লাগে? তারপর ফের প্রশ্ন উঠল, তাই যদি হবে তবে রাম কবিরাজের নাম শুনে ভূত পালায় কেন? সেও তো নাম। আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, তা বটে। তবে কিনা কবিরাজ মশাইয়ের নামটা একেবারে সোজাসুজি রাম, তার আগে বা পরে কিছু যুক্ত নেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হল, ভূতের মনস্তত্ত্বও বোঝা ভার। কখনো তারা রামনাম শুনে আঁতকে ওঠে, কখনো কোনো কোনো রামকে তারা কেয়ারই করে না। আবার ধরো না কেন, কোনো ভূত যদি ভুল করে বে-খেয়ালে রাম কবিরাজের নাম করেই বসে, তাহলে আমাদের কী করার আছে? ভূতেরও তো ভুল হয়! পুরো ব্যাপারটাই ভারি গণ্ডগোলের। আমি তাই লেখাটা শোধরালাম না। রামনাম আর রামের নাম নিয়ে গণ্ডগোল সহ-ই বইটা ছাপা হল। তোমরা বরং কোনো ভাল ভূত পেলে তার কাছ থেকে সত্যি কথাটা জেনে নিও।
.
০১.
বার্ষিক পরীক্ষায় অঙ্কে তেরো পেয়ে বুরুন একেবারে বোকা বনে গেল। সে ইতিহাসে আশি, বাংলায় পঁয়ষট্টি, ইংরিজিতে ষাট এরকম সব নম্বর পেয়েছে, কিন্তু অঙ্কে তেরো।
হেডমাস্টারমশাই শচীন সরকার বরিশালের লোক। যেমন তেজী তেমনি রাগী। তা বলে ছেলেদের মারধর করেন না। কিন্তু তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালে সমস্ত স্কুলটায় উঁচ পড়লে শব্দ শুনতে পাবার মতো অবস্থা। তিনি প্রত্যেকটি ছাত্রকে ভাল চেনেন, প্রত্যেকের নাম-ধাম স্বভাব-স্বাস্থ্য-অভ্যাস সব তাঁর নখদর্পণে। রেজাল্ট বেরোলে বুরুনকে ডেকে তিনি বললেন, “যে ছেলে গণিত জানে না, সে বড় হয়ে কী হয় জানো? বেহিসাবী, অমিতব্যয়ী আর আপ্রাকটিক্যাল। গণিতের শিক্ষা মানুষের বনিয়াদকে শক্ত করে দেয়। মন এবং চিন্তাশক্তি স্বচ্ছ হয়। ভাবপ্রবণতা কমে যায়। যে গণিতের শিক্ষা ঠিকমতো করেনি, আমার মতে সে ভাল ছেলে নয়।”
বাড়িতে ফিরতে বাবা বুরুনকে ডেকে পাঠালেন নিজের ঘরে। বাবা অসম্ভব রাশভারী লোক। ভাল ডাক্তার বলে তাঁর খুব নামডাক। খুব ব্যস্ত মানুষ, নিজের ছেলেমেয়েদের খোঁজখবর
করবার তাঁর বড় একটা সময় হয় না। বলতে কী, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তিনি খুবই কম কথা বলেন। প্রয়োজন না হলে একনাগাড়ে সাত-আট দিন পর্যন্ত কথাই বলেন না। তাই বুরুন এবং তার ভাই-বোনরা বাবাকে এক রহস্যময় মানুষ বলে জানে। সামনে যেতে ভয় পায়।
বুরুন যখন বাবার ঘরে গেল, বাবা তখন জানালার ধারে ইজিচেয়ারে বিশ্রাম নিচ্ছেন। গলার স্টেথোকোপ এবং গায়ের পোশাক ঠিকঠাক আছে। অর্থাৎ এক্ষুনি রোগী দেখতে বেরোবেন। বুরুন ঘরে ঢুকতেই বাবা হাত বাড়িয়ে বললেন, “প্রোগ্রেস রিপোর্টটা দেখি।”
বুরুন ভয়ে-ভয়ে ভাঁজ-করা কাগজটা হাতে দিতে, বাবা ভ্রূ কুঁচকে খুব বিরক্তির সঙ্গে চেয়ে দেখলেন নম্বরগুলো। তারপর কাগজটা ফেরত দিয়ে বললেন, “আমিও ছাত্রজীবনে অঙ্কে খুব ভাল ছিলাম না। কিন্তু আশি-নব্বই না পেলেও চল্লিশ-পঞ্চাশ পেতে অসুবিধে হত না।”
বুরুন মেঝের দিকে চেয়ে রইল।
বাবা উঠতে উঠতে বললেন, “কাল থেকে কালী মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে রোজ পড়তে যাবে। হেঁটে যাবে। হেঁটে আসবে।”
করালী মাস্টারমশাই থাকেন আড়াই মাইল দূরে কামরাঙায়। বোজ সেখান থেকে সাইকেলে ইস্কুলে আসেন। অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে তাঁর প্রচণ্ড নাম-ডাক। তিনি নাকি খাওয়ার শেষে ভাতের থালায় আঙুল দিয়ে অঙ্ক করেন, বড় বড় সব অঙ্কের স্বপ্ন দেখেন, লোকে যেমন গল্প-উপন্যাস পড়ে, কালী স্যার ঠিক তেমনিভাবে অঙ্কের বই পড়েন। লোকে যেমন দুঃখের গল্প পড়ে কাঁদে, হাসির গল্প পড়ে হাসে বা ভূতের গল্প পড়ে ভয় পায়, করালী স্যারও নাকি তেমনি অঙ্কের মোটা মোটা বই পড়তে পড়তে কখনো হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠেন, কখনো বা খুচ-খুচ করে কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল মোছেন, আর কখনো কোনো ভুল অঙ্ক দেখলে ভয়ে শিউরে উঠে “রাম রাম রাম রাম করতে থাকেন। ভারি আপনভোলা মানুষ। ছাত্রদের কারো নাম তাঁর মনে থাকে না। কারো বাড়িতে নেমন্তন্ন খাওয়ার পর যদি কেউ জানতে চায় করালীবাবু, রুই মাছটা কেমন খেলেন?” করালীবাবু ভারি অবাক হয়ে বলেন, “রুইমাছ! রুইমাছ ছিল নাকি?” একবার পায়েস খাওয়ার পর সেঁকুর তুলে বলেছিলেন, “দইটা অতি চমৎকার। এত মিষ্টি দই খাইনি।” অঙ্কের ওরকম দিকপাল শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও কালীবাবু কিন্তু পয়সাকড়ির হিসেবে ভারি কাঁচা। এক টাকা চার আনা কেজির উচ্ছের আড়াইশো গ্রামের দাম কত হয়, তা বাজারে গিয়ে কিছুতেই ঠিক করে উঠতে পারেন না। অসহায়ভাবে দোকানদারকেই বলেন, “বাবা, তুমিই হিসেব-টিসেব করে পয়সা গুনে রাখো। আমি অঙ্কে ভারি কাঁচা।”