অঘোরকৃষ্ণের ভারী রাগ হল। কারণ, তাঁর বাবা হরিকৃষ্ণের হাতেও যে মোটেই টিপ নেই তা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। এলোপাতাড়ি ছোঁড়া ঢিলগুলো একটাও কোনও হনুমানের গায়ে লাগেনি। বরং একটা ঢিল অঘোরকৃষ্ণের কবজি জখম করেছে, আর-একটা আর-একটু হলেই তাঁর মাথা ফাটিয়ে দিত। কিন্তু এসব কথা হরিকৃষ্ণকে বলার মতো বুকের পাটা কার আছে! পৃথিবীতে চিরকালই অত্যাচারীরা অত্যাচার করে এসেছে, আর অত্যাচারিতরা মুখ বুজে থেকেছে। এই অবিচারের জন্যই তো লোকে কমিউনিস্ট হয়!
হরিকৃষ্ণ আবার ঢিল ছুঁড়তে শুরু করেছেন। ঠকাস-ঠকাস করে চারদিকে ঢিল এসে পড়ছে। মাথা বাঁচাতে অঘোরকৃষ্ণ তাড়াতাড়ি দূরে সরে এলেন। একেবারে বাগানের পাঁচিলের ধার ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়ে তবে নিশ্চিন্ত।
কিন্তু নিশ্চিন্ত হওয়ার কি জো আছে? হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে খুব অমায়িক গলায় বলল, “অঘোরবাবুর কি সময়টা একটু খারাপ যাচ্ছে?”
“কে?” বলে লাঠি বাগিয়ে অঘোরকৃষ্ণ ঘুরে দাঁড়ালেন, যা দেখলেন তাতে তাঁর চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। প্রায় দেড় মানুষ সমান উঁচু পাঁচিলের ওপর গোঁফ-দাড়িওয়ালা একটা লোক ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে আছে। পরনে ময়লা একটা ছেঁড়া পাতলুন, গায়েও একটা আধময়লা বোম খোলা বিবর্ণ জামা। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হল, তার দু’পাশে তিনটে-তিনটে করে মোট ছ’টা হনুমান বেশ শান্তশিষ্ট হয়ে বসে আছে। এত নিশ্চিন্তে বসে থাকার কথা নয়, কারণ দেয়ালের ওপর কাঁচ আর পেরেক বসানো আছে।
কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থেকে অঘোরকৃষ্ণ দাঁত কড়মড় করে বললেন, “তুমি কে হে বেয়াদব? দেয়ালে উঠেছ যে বড়! কী মতলব?”
লোকটা একগাল হেসে বলল, “মতলব কিছু খারাপ নয় মশাই। এই আপনাদের বাগানটা বসে বসে দেখছি।”
“বাগান দেখছ? না কি আর কিছু! আর ওগুলো নিশ্চয়ই তোমার পোষা হনুমান! আমার বাগানে কস্মিনকালে কখনও হনুমানের উৎপাত হয়নি! তাই ভাবি, হঠাৎ এখানে হনুমান এল কোত্থেকে! এখন বুঝতে পারছি, এ তোমারই কাজ।”
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “আজ্ঞে না, আমি কস্মিনকালেও কোনও হনুমান পুষিনি মশাই।”
“তা হলে ওগুলো তোমার কাছে অমন ভালমানুষের মতো বসে আছে কী করে?”
লোকটা একটু হেসে বলল, “জাতভাই মনে করেছে বোধহয়। আমি কি আর মানুষের মধ্যে গণ্য হওয়ার যোগ্য? যেখানেই যাই, কুকুর-বেড়াল-পশু-পক্ষী পিছু নেয়। শুধু মানুষের কাছেই কলকে পাই না মশাই। এই একটু দেয়ালে উঠে আরাম করে বসে আছি বলে আপনি কত কথাই না শোনাচ্ছেন!”
অঘোরকৃষ্ণ হুঙ্কার দিলেন, “আরাম করে বসে আছ মানে! দেয়ালে কাঁচ নেই? পেরেক নেই?”
“থাকবে না কেন? খুব আছে।”
“সেগুলো ফুটছে না?”
লোকটা হেসে বলে, “গরিবের হল গিয়ে মোটা চামড়া। সারাজীবন কণ্টকাকীর্ণ পথ ধরেই তো আমাদের চলা। ওসব কি আমাদের লাগে?”
“ওঃ, কথার দেখছি খুব বাহার! এখন ভালয়-ভালয় নামবে কি না!”
“কোনদিকে নামি বলুন তো! ভেতরে, না বাইরে? ভেতরে নামলে আপনি আমাকে পাকড়াও করতে পারেন। আর বাইরে নামলে আমি পালাতে পারি।”
“তোমাকে পাকড়াও করার ইচ্ছে আমার নেই। তুমি তোমার হনুমানদের নিয়ে কেটে পড়।”
“আজ্ঞে, হনুমানগুলো যে আমার নয়।”
“আলবাত তোমার।”
“আজ্ঞে না। বিশ্বাস করুন। আমি দেয়ালে উঠে আপনাদের বাগানটা দেখছিলুম, হনুমানগুলো আপনার বাবামশাইয়ের ঢিলের ভয়ে গুটিগুটি এসে আমার দু’পাশে বসে পড়ল। তবে যা-ই বলুন, আপনার চেয়ে আপনার বাবামশাইয়ের ঢিলের হাত অনেক ভাল।”
অঘোরকৃষ্ণ খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “ছাই ভাল, একটাও ঢিল হনুমানের গায়ে তো দুরের কথা, লেজেও লাগেনি। এলোপাতাড়ি ছুড়ছেন, একটু হলে আমার মাথাটাই ফাটত।”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “না মশাই, ন্যায্য বিচার যদি করতে হয় তবে আমি বলব, আপনার বাবামশাইয়ের হাতের জোর অনেক বেশি। কাল তো দেখলুম আপনার ঢিলগুলো ওই মাদার গাছটাও পেরোয়নি। আর আপনার বাবার ঢিল ওই জামগাছটা অবধি এসেছে।”
অঘোরকৃষ্ণ ভারী ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, “আমার হাতে জোর নেই বলছ? তা হলে হরবাবুর বৈঠকখানার কাঁচ আর নবকৃষ্ণর মেটে কলসি ভাঙলুম কী করে? অ্যাঁ?”
লোকটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, “ওই আনন্দেই থাকুন। আপনার বাবামশাই কী কী ভেঙেছেন তা জানেন কি? তিনি পানুবাবুর শোয়ার ঘরের ড্রেসিংটেবিলের আয়না চুরমার করে দিয়েছেন, পানুবাবু থানায় যাওয়ার জন্য ধুতিতে মালকোঁচা মারছেন এখন। তা ছাড়া চৌধুরীবাড়ির ছাদের পাথরের পরীর একটা ডানা ঢিল মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। সে বাড়ির দরোয়ানরা ভয় খেয়ে খাঁটিয়ার তলায় ঢুকেছে বটে, তবে তারাও লাঠিসোঁটা নিয়ে এল
বলে! তার ওপর আপনার বাবামশাইয়ের ঢিলে কালীপদর নারকোল গাছ থেকে একটা নারকোল পড়ে তার পিসিমার টালির চাল ফুটো হয়ে গেছে। কালীপদর পিসিমা কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠে গাঁক গাঁক করে চেঁচিয়ে শাপশাপান্ত করছেন। না মশাই, আমাকে স্বীকার করতেই হবে, আপনার বাবামশাইয়ের ঢিলের হাত আপনার চেয়ে ঢের ভাল।”
একথায় খুবই অসন্তুষ্ট হয়ে অঘোরকৃষ্ণ বললেন, “থাক থাক, তোমাকে আর ফোঁপরদালালি করতে হবে না। সবাই হল শক্তের ভক্ত আর নরমের যম। বাবার হাঁকডাক আর দাপট বেশি বলেই সবাই তাঁকে তেল দেয়। তবে আমিও বলে রাখছি, এক মাঘে শীত যায় না। ঢিল মারা কাকে বলে তা আমিও দেখিয়ে দেব।”