এই যে এই অঞ্চলে লোকে তাঁকে রয়াল বেঙ্গল টাইগার বলে উল্লেখ করে, তা তো আর এমনিতে নয়। তাঁর প্রবল প্রতাপ, সাঙ্ঘাতিক ব্যক্তিত্ব এবং দুর্দান্ত কর্তৃত্ব করার ক্ষমতার জন্যই খাতির করে লোকে তাঁর ওই নাম দিয়েছে। এর জন্য মনে-মনে তিনি খুশিই ছিলেন। কিন্তু এই পরশুদিন তাঁর বন্ধু ডি এম এস, জ্যোতিষার্ণব, সাহিত্য সরস্বতী, বিদ্যাবারিধি, পুরাণার্ণব, কাব্যশ্রী, রোগাভোগা নটবর হালদার তাঁর উত্তরের বারান্দায় বসে সকালবেলায় চা খেতে-খেতে হঠাৎ বিজ্ঞান নিয়ে তর্ক জুড়ে দিল। তার বক্তব্য, “বিজ্ঞান-টিজ্ঞান সব বোগাস, ওতে মানুষের কোনও কৃতিত্বই নাই। ভগবানই সব দিয়ে রেখেছেন, মানুষ শুধু ভগবানের নকল করে এসেছে এতকাল।”
অঘোরকৃষ্ণ চটে উঠে বললেন, “নকল মানে? মানুষ বুদ্ধি খাঁটিয়ে, সুক্ষ্ম হিসেবনিকেশ করে যে এত আবিষ্কার করল, তা নকল হতে যাবে কেন?”
তখন নটবর বলল, “আহা, বুদ্ধিটাও তো ভগবানই দিয়েছেন রে বাপু।”
তর্ক যখন তুঙ্গে উঠেছে তখনই নটবর বলে বসল, “অত তর্জন-গর্জন করছ কেন? তুমি কি বাঘ-সিংহী নাকি যে, তর্জন-গর্জনে ভয় খাব?”
তখন বুক চিতিয়ে অঘোরকৃষ্ণ বললেন, “আলবত বাঘ। লোকে আমাকে তা-ই বলে।”
“সেটা তোমার প্রশংসা করার জন্য বলে না, বলে তোমার গায়ের বোঁটকা গন্ধের জন্য।”
অঘোরকৃষ্ণ ভারী অবাক হয়ে বললেন, “বোঁটকা গন্ধ! আমার গায়ে বোঁটকা গন্ধ! কই, কোথায়?” বলে তাড়াতাড়ি নিজের গা শোঁকার জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন।
নটবর বলল, “আহা, বোঁটকা গন্ধটা কথার কথা, বলছিলাম ওইরকমই কোনও হেঁদো কারণে তোমাকে সবাই বাঘ বলে হাসিঠাট্টা করে আর কি। তুমি তো আর আশু মুখুজ্জে নও কিংবা বাঘা যতীনের মতো লালমুখোদের সঙ্গে লড়াইও করোনি। তোমাকে বাঘ বললে বাঘেদের অপমানই হয়, তারা চাইলে তোমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলাও করতে পারে।”
নটবরের মতো রোগাভোগা লোকও আজকাল তাঁকে অপমান করে যাচ্ছে, এটা খুবই ভাবনার কথা।
অঘোরকৃষ্ণের দুঃখের শেষ এখানেই নয়। তাঁর বয়স এখন পঁয়ষট্টি। তাঁর বাবা হরিকৃষ্ণের বয়স এখন নব্বই। অতি শক্তসমর্থ হরিকৃষ্ণের এখনও মাথা-ভর্তি কাঁচা-পাকা চুল, মুখে বত্রিশটা শক্ত দাঁত। পাঁঠার হাড় চিবিয়ে খুঁড়ো করে ফেলতে পারেন। রীতিমত ডনবৈঠক করেন, মুগুর ভাঁজেন, পাঁচ-দশ মাইল টানা হাঁটতে পারেন। দাপটও প্রচণ্ড। রোজ সকালে বাবাকে প্রণাম করতে যান অঘোরকৃষ্ণ, আর প্রতিদিনই হরিকৃষ্ণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “কবে যে তুই একটা মানুষের মতো মানুষ হবি, সেটাই বুঝতে পারি না। রাত্রিবেলা বউমা এসে বলল, কালও নাকি তুই বাজার থেকে একটা কানা বেগুন এনেছিস। এখনও তুই নাকি পাতে নিম-বেগুন দিলে থালার নীচে চালান দিয়ে লুকিয়ে ফেলিস। সকালে দুধ খাওয়ার কথা, তা সেটা নাকি বেড়ালের বাটিতে চুপিচুপি ঢেলে দিয়ে আসিস। শুনতে পাই, সেদিন নাকি ব্রজমাস্টারকে বাজারে দেখেও পেন্নাম করিসনি! আর ইদানীং শুনতে পাচ্ছি, তুই নাকি দুপুরবেলায় ছাদে উঠে চারদিকে ঢিল মারিস!হরবাবুর বৈঠকখানার কাঁচ আর নবকৃষ্ণর মেটে কলসি নাকি তোর ঢিলেই ভেঙেছে!”
অভিযোগগুলো কোনওটাই মিথ্যে নয়। অঘোরকৃষ্ণ তাই মাথা নিচু করে ঘাড় চুলকোতে থাকেন।
হরিকৃষ্ণ ভারী বিরক্ত হয়ে বললেন, “অন্যগুলো তবু সহ্য করা যায়, কিন্তু দুপুরবেলা ঢিল ছোঁড়াটা তো মোটেই কাজের কথা নয়। ঢিল মারিস কেন?”
অঘোরকৃষ্ণ মিনমিন করে বললেন, “আজ্ঞে চার-পাঁচটা হনুমান এসে ক’দিন ধরে বাগানে খুব উৎপাত করছে, সেইজন্যই ঢিল মেরে তাড়াচ্ছিলাম।”
হরিকৃষ্ণ বললেন, “হনুমানেরা চিরকালই গাছের কলাটা মুলোটা খেয়ে আসছে, তাই বলে ঢিল মারতে হবে?”
“আর হবে না।”
হরিকৃষ্ণ অত্যন্ত কঠিন চোখে ছেলের আপাদমস্তক একবার
দেখে নিয়ে বললেন, “আর যেন তোমার সম্পর্কে কোনও নালিশ শুনতে না হয়–। এখন তুমি যেতে পারো।”
না, অঘোরকৃষ্ণ অনেক ভেবে দেখলেন, সময়টা তাঁর খারাপই যাচ্ছে। কারণ, দুপুরবেলা তিনি যখন ভাত খাওয়ার পর সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছেন তখনই তাঁর জানলার পাশে পেয়ারা গাছে হনুমানগুলো এমন দাপাদাপি শুরু করল যে, তিষ্ঠোতে না পেরে তিনি উঠে পড়লেন। ঢিল মারা বারণ, সুতরাং বেতের মজবুত লাঠিগাছ বাগিয়ে তিনি বাগানে ঢুকে যখন বীরবিক্রমে এগোচ্ছেন হঠাৎ কোথা থেকে একটা ঢিল এসে তাঁর ডান কাঁধ ঘেঁষে মাটিতে পড়ল। অঘোরকৃষ্ণ আঁতকে উঠে চারদিকে চাইছেন। সঙ্গে-সঙ্গে উপর্যুপরি আরও তিন-চারটে বড় বড় ঢিল এসে গাছপালায় পড়তে লাগল। একটা পড়ল তাঁর বাঁ হাতের কবজিতে। তিনি ককিয়ে উঠলেন। আর-একটা সাঁ করে তাঁর মাথা ঘেঁষে কান ছুঁয়ে চলে গেল। কিন্তু ঢিলটা মারছে কে? ঠিক দুপুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা–এই সেই বৃত্তান্ত নয়তো। তিনি সভয়ে একটা ঝুপসি আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষা করতে করতে চারদিকে চাইতে লাগলেন।
হঠাৎ ছাদের দিকে নজর যেতেই তিনি হাঁ। স্পষ্ট দেখলেন ছাদে দাঁড়িয়ে বীরবিক্রমে ঢিল ছুড়ছেন তাঁর বাবা হরিকৃষ্ণ। হাতের শেষ ঢিলটা ছুঁড়ে হরিকৃষ্ণ আত্মতৃপ্তিতে হাতটাত ঝেড়ে আপনমনেই হেসে বললেন, “অপদার্থ! অপদার্থ! বুঝলে! অঘোরটা একেবারেই অপদার্থ। হাতে টিপ নেই মোটে, হনুমান মারতে গেছে! গিয়ে কার কাঁচ ভাঙছে, কার কলসি ভাঙছে। এ যুগের ছেলেদের কি আর সেই সাধনা আছে, না অধ্যবসায়? ঢিল ছুঁড়তেও তো এলেম দরকার রে বাপু!”