অধিক হইয়াছিল। গজাননের খ্যাতি ক্রমে তুঙ্গে উঠিতেছিল। রাজা মঙ্গলও তাহার সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। বলা বাহুল্য, এইরূপ ব্যক্তিগণ তাঁহাদের খ্যাতিহরণের কারক বলিয়া রাজা গজারা ইহাদের বেশি পছন্দ করেন না। রাজা মঙ্গল সুতরাং গজাননের উপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। উপরন্তু এক দিবস রাজা এক কাঠুরিয়াকে মল্লযুদ্ধে আহ্বান করিয়া যখন তাহাকে বধ করিবার উদ্যোগ করিতেছেন তখন অকস্মাৎ গজানন সেই মল্লভূমিতে আবির্ভূত হইয়া অসহায় ব্যক্তিটিকে রাজরোষ হইতে রক্ষা করিবার নিমিত্ত কহিল, “মহারাজ, এই ব্যক্তি মল্লযুদ্ধের কিছু জানে না। ইহাকে পরাজিত করিয়া হস্ত কলঙ্কিত করিবেন কেন! আমার সহিত মল্লযুদ্ধ করুন। মহাশয়, বলাই বাহুল্য, রাজা মঙ্গলের অমিত শক্তির নিকট গজানন নিমেষে পরাজিত হইয়া ভূমিশয্যা গ্রহণ করিল। গজাননের উপর রাজার সঞ্চিত ক্রোধ তো ছিলই, সুতরাং রাজা তাহাকে পাড়িয়া ফেলিয়া উপর্যুপরি আঘাত করিলেন। তাহাতেও মরিল না দেখিয়া শাসরোধ করিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, গজানন মরিল না। রাজা যতই চেষ্টা করেন, যত ভয়ঙ্কর আঘাতই করেন, দেখা যায় গজানন দিব্যি বাঁচিয়া আছে এবং মুচকি-মুচকি হাস্য করিতেছে। তখন ক্রোধাবিষ্ট রাজা মঙ্গল সান্ত্রীদের একজনের কোষ হইতে তরবারি টানিয়া প্রথমে গজাননের মুণ্ডচ্ছেদ করিলেন। অতঃপর হস্তপদাদিও কর্তিত করিলেন। মল্লভূমি গজাননের শোণিতে রঙ্গিল হইয়া গেল।”
“আপনি কি এই গল্প বিশ্বাস করেন?”
“আমি আপনাকে কাহিনীটি শুনাইতেছি মাত্র, বিশ্বাস অবিশ্বাস আপনার উপর।”
“তারপর কী হল?”
“সে এক আশ্চর্য কাহিনী। দেখা গেল, গজাননের ছিন্ন মুণ্ডের চক্ষুদ্বয় পিটপিট করিতেছে, কর্তিত হস্তের অঙ্গুলিগুলি দিব্য নড়িতেছে, ছিন্ন পদযুগলও কম্পিত হইতেছে। অকস্মাৎ মুণ্ডটি শুন্যে উঠিয়া হঠাৎ গোলার মতো রাজা মঙ্গলের দিকে ধাবিত হইল। ২২
“ওঃ, এ যে আষাঢ়ে গল্প!”
“হাঁ মহাশয়, আর শুনিবেন কি?”
“হ্যাঁ, শুনব।”
“আষাঢ়ে গল্প হইলেও চিত্তাকর্ষক, কী বলেন?”
“আমি গল্পটা শুনছি গজানন লোকটাকে বুঝবার জন্য।”
“তাহা অনুমান করিতে পারি। নহিলে এই খর দ্বিপ্রহরে বৃক্ষের ছায়ায় উপবেশন করিয়া রূপকথা শুনিবার মতো যথেষ্ট সময় যে আপনার হাতে নাই, তাহা না বুঝিবার মতো নির্বোধ আমি নহি।”
“তারপর কী হল বলুন।”
“কহিতেছি মহাশয়। গজাননের মুণ্ড নক্ষত্ৰবেগে ধাবিত হইয়া গিয়া রাজা মঙ্গলের উপর পড়িল। মল্লবীর মঙ্গল এতই বিস্ময়াভিভূত হইয়া পড়িয়াছিলেন যে, ঘটনার আকস্মিকতায় নড়িতে পারেন নাই। প্রথম আঘাতেই তিনি ভূপাতিত হইলেন। তাহার পর মুণ্ডটি তাহাকে উপর্যুপরি আঘাত করিতে লাগিল। সেই আঘাতে আঘাতে জর্জরিত রাজা ক্রমে অবসন্ন ইয়া পড়িলেন। তারপর ধীরে ধীরে চক্ষু বুজিলেন। তাঁহার প্রাণবায়ু নির্গত হইয়া গেল। অপরদিকে গজাননের হস্তপদাদিও বসিয়া নাই, বাম ও দক্ষিণ হস্ত ও দুই পদ শূন্যে ধাবিত হইয়া রাজার অমাত্য ও বশীভূত কর্মচারীদের ঘুষা ও পদাঘাত করিতে লাগিল। পিতা-মাতার নাম ধরিয়া চিৎকার করিতে করিতে তাহারা পলায়নপর হইল। কিন্তু বেশিরভাগই প্রহারে জর্জরিত হইয়া সংজ্ঞা হারাইয়া লুটাইয়া পড়িল। রাজার প্রিয় জল্লাদ নফরচন্দ্রকে গজাননের দক্ষিণ হস্ত স্বাসরোধ করিয়া হত্যা করিল। তাহার পর যাহা হইল তাহাও অপ্রত্যাশিত।”
“হাত-পা-মুণ্ডু সব জুড়ে গেল তো?”
“না মহাশয়। সেইখানেই বিস্ময়। গজাননের মুণ্ড ও হস্তপদাদি যে-যাহার নিজের মতো বিভিন্ন দিকে প্রস্থান করিতে লাগিল। কোনওটা বায়ু কোণে, কোনওটি নৈঋতে, কোনওটি পূর্বে, কোনওটি অগ্নি কোণে। সবশেষে ধড়টি ব্যোমমার্গে ধাবিত হইয়া অদৃশ্য হয়।”
“আসল ঘটনা বোধ হয়, গজানন রাজা মঙ্গলের হাতে মারা পড়ে। কিন্তু মারা যাওয়ার আগে সে কোনওভাবে মঙ্গলকেও হত্যা করেছিল। সেটাই লোকের মুখে অতিরঞ্জিত হয়ে–”
“হইতে পারে। তবে আপনার পূর্বপূরুষ সদাশিব এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। অতিরঞ্জন যদি হইয়া থাকে তবে তাহাতে তাঁহারও অবদান আছে।”
“অতিরঞ্জন হতে পারে, আবার রূপকও হতে পারে।”
“সকলই সম্ভব। কিন্তু গজাননকে লইয়া আপনার কিছু সমস্যা দেখা দিয়াছে বলিয়া মনে হয়।”
“হ্যাঁ। সমস্যা গজাননের পুনরাবির্ভাব নিয়ে। অনেকেই দাবি করছে যে, জাদুকর গজানন বেঁচেবর্তে আছে। শুধু তাই নয়, গজানন তাদের সঙ্গে যোগাযোগও রক্ষা করে থাকে।”
“মহাশয়, এই লোকশ্রুতি আমার কানেও আসিয়াছে।”
“আমি এই গাঁজাখুরি গল্পটার শেষ দেখতে চাই। আমার ছেলে গজাননের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়।”
শাসন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “পৃথিবী বিচিত্র স্থান।”
“আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনি নিঃসশয় নন।”
“না মহাশয়, কোনও ব্যাপারে আমি চুড়ান্ত মনোভাব পোষণ করি। তাহাতে আখেরে ঠকিতে হয়।”
“গজাননের পক্ষে বেঁচে থাকা কি সম্ভব?”
“বাঁচিয়া থাকা কতরকমের আছে, আপনি কি জানেন?”
৩. অঘোরকৃষ্ণবাবুর সময়টা
অঘোরকৃষ্ণবাবুর সময়টা বিশেষ ভাল যাচ্ছে না। গতকাল সন্ধেবেলা নাতি আর নাতনিদের সঙ্গে কুইজ কনটেস্টে গো-হারা হেরেছেন। মহাত্মা গাঁধীর বাবার নাম, মেরি গাইয়ের ইংরিজি প্রতিশব্দ আর ক্রিকেটে ‘চায়নাম্যান’ কাকে বলে তা বলতে পারেননি! অবশ্য তাঁর মনঃসংযোগ করতে না পারার যথেষ্ট কারণও ছিল। দিন চারেক আগে খুবই দামি একজোড়া নতুন চটি কিনেছেন। পরশুদিন তাঁর সেজো শালা হরিপদ ভুল করে সেই চটি পরে চলে গেছে। কাছেপিঠেনয়। হরিপদ গেছে নাগপুরে, বছরখানেকের মধ্যে তার আর আসার সম্ভাবনা নেই। কথাটা তুলতেই স্ত্রী ফোঁস করে উঠেছেন, “কেমন আক্কেল তোমার বলো তো! না হয় নিয়েইছে দেড়শো টাকার একজোড়া চটি, তাতে কোন রাজ্যপাট যেতে বসেছে তোমার! তাড়াহুড়োয় খেয়াল করেনি, বুঝতে পারলে ঠিক পার্সেল করে পাঠিয়ে দেবে।” পার্সেলের ভরসা অঘোরকৃষ্ণ করছেন না। মোটেই। বারবার চটিজোড়া যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে আর দীর্ঘশ্বাস পড়ছে। শুধু চটি হারানোর দুঃখই নয়, গদাধরের মতো আনাড়ির কাছে গত তিনদিনে বারসাতেক দাবায় হেরেছেন। পরশু বিকেলে তো গদাধরের বোড়ের মুখে গজটা চেপে দিতে গিয়ে ঘোড়ার চাঁটে গজ উড়ে গেল। নিজের আহাম্মকির জন্য নিজেরই দু’গালে থাবড়া মারতে ইচ্ছে যায়। আর শুধু কি তাই? পরশুদিন হরিহর হাই স্কুলের রবীন্দ্র জয়ন্তীতে তাঁকে সভাপতি করতে নিয়ে গিয়েছিল। সভাপতির কাজ বড্ড যাচ্ছেতাই, সারাক্ষণ ভ্যাজরং-ভ্যাজরং ভাষণ শুনতে হয়। তাই তিনি ভাষণের সময়টায় দিব্যি ঘাড় কাত করে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলেন। তারপর যখন তাঁর নিজের ভাষণ দেওয়ার সময় হল তখন চটকা ভেঙে উঠে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি যে কেন রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান কাঁঠালপাড়ার মহিমা কীর্তন করতে লাগলেন, তা তিনি এখনও বুঝে উঠতে পারেন না। শ্রোতারা সবাই হেসে ওঠায় নিজের ভুল বুঝতে পেরে তিনি খুব গম্ভীরভাবে বললেন, “কাঁঠালপাড়া অতি ভাল জায়গা, রবীন্দ্রনাথ সেখানে জন্মালেও ক্ষতি ছিল না। কারণ কাঁঠালপাড়ায় অনেক মহাপুরুষ জন্মেছেন। যদিও কে কে জন্মেছেন তা তাঁর ঠিক মনে পড়ছে না ইত্যাদি।” ফলে সভায় হাসির অট্টরোল উঠল। অঘোরকৃষ্ণবাবু ভ্যাবাচাকা খেয়ে বসে পড়লেন। আর সেখানেই শেষ নয়, গত কয়েকদিনে আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে। গতকাল কালু মুদির দোকানে তেরো টাকা বিয়াল্লিশ পয়সার সঙ্গে তেত্রিশ টাকা বাইশ পয়সা যোগ দিয়ে কী করে যে তিনি আটাত্তর টাকা আশি পয়সা হিসেব করলেন কে জানে। কালু খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, “মেসোমশাইয়ের দেখছি ভীমরতি ধরেছে।”