“মহাশয়, ভাঙিয়া বলুন।”
“আমার পরিবারে একটা বদ্ধমূল ধারণা আছে যে, জাদুকর গজানন এখনও বেঁচে আছেন। তিনি মাঝে-মাঝে এসে হাজির হন এবং নানা অলৌকিক কাণ্ডকারখানা করে হঠাৎ উধাও হয়ে যান।”
শাসন হেসে বলল, “মহাশয়, আপনি বিজ্ঞানী, মানুষের ভুল ধারণা ঘুচাইয়া দেওয়ার চেষ্টা অবশ্য করিবেন। কিন্তু জোর করিয়া কিছুই করিয়া উঠিতে পারিবেন না। এই সকল কার্যের জন্য ধৈর্য ও সহানুভূতি প্রয়োজন।”
“সেটা আমার আছে বলেই আমি গজাননের মিথ ভাঙতে চাইছি। গজাননের গল্পটা কি আপনি জানেন?”
“জানি মহাশয়, অনেকেই জানে। আপনার ঊর্ধ্বতন অষ্টম পুরুষ সদাশিব সেই বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া যান।”
“কিন্তু সদাশিবের পুঁথি তো পাওয়া যায়নি!”
“না মহাশয়, পুঁথিটি আমিও কম অনুসন্ধান করি নাই। কিন্তু পুঁথি বিলুপ্ত হইলেও সদাশিবের বিবরণ মানুষের মুখে-মুখে ফিরিয়া থাকে। সুতরাং পুঁথির কাহিনী বাঁচিয়া আছে। রাজা মঙ্গল রায় যে খুব অত্যাচারী রাজা ছিলেন তাহা বলা যায় না। তাঁহার রাজ্য সুশাসিতই ছিল। তবে রাজা মঙ্গল ছিলেন মহা বলশালী মল্লবীর। তাঁহার সমতুল্য মল্লবীর কেহ ছিল না। কিন্তু রাজার মস্ত দোষ ছিল, মল্লযুদ্ধে পরাজিত প্রতিপক্ষকে তিনি মল্লভূমিতেই বধ করিতেন। বধ না করিলে তাঁহার শান্তি হইত না। এই নরহত্যার পৈশাচিক আনন্দ তাঁহাকে এমনই উত্তেজিত করিয়া তুলিত যে, তিনি কয়েকদিন আনন্দে আত্মহারা হইয়া উন্মত্তের মতো আচরণ করিতেন।”
“হ্যাঁ, রাজা মঙ্গল একটি সাইকোটিক কেস। সম্ভবত ম্যানিয়াক।”
“হাঁ মহাশয়, মনোবিকলন গ্রন্থাদিতে এইরকম প্রবণতাযুক্ত মানুষের বিস্তর উদাহরণ পাওয়া যায়। প্রথম-প্রথম মোটা পুরস্কারের লোভে দেশ-দেশান্তর হইতে মল্লবীরেরা রাজা মঙ্গলের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করিতে আসিত। কিন্তু ক্রমে-ক্রমে তাহাদের সংখ্যা কমিতে লাগিল। প্রথমত, রাজা মঙ্গল অতি দুর্ধর্ষ মল্লযোদ্ধা, তাহাকে পরাজিত করিয়া পুরস্কার লাভ করা অতীব কঠিন। দ্বিতীয়ত, পরাজিত হইলেই বধ হইবার ভয়। ফলে যত দিন যাইতে লাগিল তো মল্লযোদ্ধাদের আগমন হ্রাস পাইতে পাইতে বন্ধ হইয়া গেল। কিন্তু রাজা মঙ্গল তাহাতে ক্ষান্ত হইবেন কেন? মল্লযুদ্ধে প্রবল আকর্ষণ ও বধাভিলাষ তাঁহার কাণ্ডজ্ঞান লুপ্ত করিয়া দিল। তিনি অতঃপর যাহাকে তাহাকে মাঠঘাট হইতে ধরিয়া আনিতে সান্ত্রীদের পাঠাইতেন। সান্ত্রীগণ নিরীহ পথচারী বা কৃষক-শ্রমিক যাহাকে হউক ধরিয়া আনিত। তাহারা মল্লযুদ্ধের ম-ও জানিত না। কিন্তু রাজা মঙ্গল তাহাদের মল্লভূমিতে ধরিয়া পৈশাচিক আনন্দে বধ করিতে লাগিলেন।”
“বিস্মিত হয়ে গন্ধর্ব বলল, “রোজ?”
একটু হেসে মাথা নেড়ে শাসন বলে, “না মহাশয়, প্রত্যহ নহে। পক্ষকালে একবার। পঞ্চদশ দিবস অন্তর অন্তত একটি নরহত্যা না করিতে পারিলে রাজা মঙ্গল অতিশয় অশান্ত ও অস্থির হইয়া পড়িতেন। রাজাকে সন্তুষ্ট রাখিবার জন্য অমাত্য ও রাজকর্মচারীগণ এই পৈশাচিক কর্মের সহায়তা করিত। নহিলে তাহাদের নিজেদের গাত্রচর্ম অক্ষত থাকে না।”
গন্ধর্ব বলল, “বুঝেছি। বলুন।”
“এইরূপে প্রজাদের মধ্যে ক্রমশ অসন্তোষ দেখা দিতে লাগিল। অনেকে বিশেষ ভীত ও সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল। প্রাপ্তবয়স্ক যুবা পুরুষরা প্রকাশ্য স্থানে বিচরণ করিতে নিরাপত্তার অভাব বোধ করিতে লাগিল। অনেকে রাজ্য ছাড়িয়া অন্যত্র বাস উঠাইয়া লইয়া গেল। ঠিক এই সময়ে এক অতি দুর্যোগের নিশায় আপনার পূর্বপুরুষ সদাশিবের কুটিরের দ্বারে করাঘাত শুনা গেল। সদাশিব দরিদ্র ব্রাহ্মণ, চোর-ডাকাইতের ভয় তাহার বিশেষ ছিল না। দুর্যোগে কোনও নিরাশ্রয় আসিয়াছে মনে করিয়া তিনি কপাট খুলিয়া অপরিচিত এক আগন্তুককে দেখিতে পাইলেন। মনুষ্যটি শীর্ণকায়, গুম্ফশ্মশ্রু সমন্বিত, পরিধানে ছিন্নবস্ত্র, বয়ঃক্রম পঞ্চবিংশতি হইতে পারে। আগন্তুক নিজের পরিচয় যাহা প্রদান করিল তাহা হইল, সে একজন জাদুকর। নানা স্থানে ঘুরিয়া সে জাদু প্রদর্শন করিয়া উদরান্নের সংস্থান করিয়া থাকে। উপস্থিত দুর্যোগে বিপন্ন হইয়া আশ্রয়প্রার্থী। বলা বাহুল্য, অতিথি-বৎসল সদাশিব তাহাকে আশ্রয় দিলেন।”
“ইনিই কি জাদুকর গজানন?”
“আজ্ঞা হ্যাঁ মহাশয়, ইনিই গজানন। নিরাশ্রয় বহিরাগত গজানন সদাশিবের গৃহেই আশ্রয় পাইয়াছিল। নগরে যে একজন জাদুকর আসিয়াছে তাহা রটিতেও বিলম্ব হইল না।”
“গজানন কীরকম ম্যাজিক দেখাত তা আপনি জানেন?”
“লোকের মুখে মুখে পল্লবিত হইয়া যাহা রটিত হইয়াছে তাহা জানি। বোধ করি অবহিত আছেন যে, সাধারণ মানুষের কল্পনাশক্তি তিলকে তাল করিয়া থাকে।”
“জানি বইকী, খুব জানি।”
“গজাননের জাদুবিদ্যা সম্পর্কেও নানা কিংবদন্তি আছে, যাহা সর্বাংশে বিশ্বাসযোগ্য নহে। সে নাকি প্রজ্বলিত অগ্নিতে হস্ত প্রবিষ্ট করাইয়া থাকিতে পারিত, হস্ত দগ্ধ হইত না। জাদুদণ্ডের আঘাতে মুত্তিকায় প্রস্রবণ সৃষ্টি করিতে পারিত। সে নাকি মৃত্তিকার ঈষৎ উপর দিয়া অর্থাৎ শূন্যে পদক্ষেপ করিয়া বিচরণ করিতে পারিত।”
“এসব তো গাঁজাখুরি।”
“এই ব্যাপারে আমি আপনার সহিত একমত। তবে গজাননের খ্যাতি শুধু জাদুবিদ্যায় নহে। শুনা যায় রাজ্যে কোথাও কোনও ব্যক্তি বিপন্ন বা আর্ত হইয়া পড়িলে গজানন সেখানে হাজির হইয়া যাইত। এক ব্যক্তি নিশাকালে অরণ্যমধ্যে ব্যাঘ্ৰকবলিত হইয়া পড়িয়াছিল। গজানন তাহাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা করে। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত আর-এক ব্যক্তিকে সে কেবল স্পর্শ করিয়া নিরাময় করিয়াছিল। জলমগ্ন বালক-বালিকাকে উদ্ধার করা, সর্পাঘাতে অপমৃত্যু রোধ, ক্ষত পরিচর্যা ইত্যাদিতেই তাহার খ্যাতি