গজানন কথাগুলো শুনতে-শুনতে হঠাৎ একটা ঢেকুর তুলতেই তার শরীরটা পক করে খানিকটা শূন্যে উঠে পড়ল, তারপর একটু হেলেদুলে পেঁজা তুলোর মতো নেমে এল নীচে।
গুনেন সরকার কথা থামিয়ে হাঁ করে দৃশ্যটা দেখল। তারপর সোজা সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল, “চর্মচক্ষে আজ এ কী দেখলাম বাবা! ইনি যে মস্ত গুনিন! সাক্ষাৎ শিবের অবতার…”
গজানন একটু যেন অপ্রস্তুত হয়ে বিড়বিড় করে বলল, “বড্ড হালকা হয়ে গেছি। নাঃ, ডিবেটা না হলেই নয়।”
খবর পেয়ে আরও পাড়াপ্রতিবেশী জড়ো হয়ে গেল। রীতিমত ভিড়। সবাই নিজের নিজের নানা সমস্যার কথা বলতে লাগল। কে কার আগে বলবে তাই নিয়ে ঝগড়াও লেগে যেতে যাচ্ছিল।
পরদিন সকালে উঠে নকুড়বাবু দেখলেন, সদর দরজা হাট করে খোলা। গজানন নেই। নেই তো নেই-ই। নকুড়বাবু খুবই দুঃখ করতে লাগলেন, “এ হেঃ! আমার ভাল হাতটা ওঁর দয়ায় হয়ে যেত। সবাই মিলে এমন বিরক্ত করল যে, লোকটা গায়েব হয়ে গেল!”
বৃন্দাবনের দিনকাল ভাল যাচ্ছে না। গত সাতদিন তার কোনও রোজগার নেই। সাধুচরণ সাহার বাড়ির জানলার গরাদ ভেঙে চুরি করতে ঢুকেছিল মাঝরাতে। ভুলচুকও কিছু করেনি। আগে মন্তর পড়ে বাড়ির লোকজনের ঘুম গাঢ় করে নিয়েছে। কুকুরের মুখবন্ধন করার মন্তরও পড়ে নিয়েছে। ঠাকুর-দেবতাদের পেন্নাম করতেও ভুল হয়নি। সবই ঠিকঠাক ছিল। গরাদ সরিয়ে ঢুকে পড়েছিল অর্ধেকটা। এমন সময় তার পায়ে লেগে টুলের ওপর রাখা একটা জলভর্তি মেটে কলসি মেঝেতে পড়ে বিকট শব্দে ভেঙে যাওয়ায় বিপত্তিটা ঘটল। সাধুচরণ তড়াক করে উঠে এক ঘা লাঠি বসিয়ে দিল কবজিতে। তারপর ‘চোর, চোর’ বলে চেঁচানি। বৃন্দাবন হাতের চোট নিয়েও যে পালাতে পেরেছে সে ভগবানের আশীর্বাদে। আর অনেকদিনের অভিজ্ঞতা আছে বলে।
কবজি ফুলে ঢোল হয়ে থাকায় দিনসাতেক আর কাজকর্ম করতে পারেনি। আজই মাঝরাতে বেরিয়েছে, হারু মণ্ডল ধান বেচে আজই কিছু টাকা পেয়েছে, সেইটে হাতাতে পারলে কয়েকদিন ভালই চলে যাবে।
হারু মণ্ডলের বাড়িতে ঢোকা বেশ সহজ কাজ। মাটির ভিটে বলে সিঁধ দিতে অসুবিধে নেই। আর হারুর ঘুমও খুব পাকা। বৃন্দাবন মন্তর-টন্তর পড়ে নিয়ে ঠাকুর-দেবতাকে প্রণাম করে সবে দক্ষিণের ঘরে সিঁধ দেওয়ার জন্য ছোট যন্তরটা চালিয়েছে, হঠাৎ কে যেন খুব ক্ষীণ গলায় বলে উঠল, “ডিবেটা যে কোথায় গেল!”
বৃন্দাবন চমকে উঠে পেছন ফিরে যা দেখল, তাতে তার মাথার চুল খাড়া হয়ে যাওয়ার কথা। একটা লোক যেন বাতাসে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। মাটির একটু ওপরে পা। একটু ক্ষয়াটে জ্যোছনায় দেখা যাচ্ছে, লোকটা বেশ রোগাভোগা আর দাড়িগোঁফ আছে।
“ভূত!” বৃন্দাবনের হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল।
লোকটা তার দিকে চেয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, “সদাশিব যে কোথায় গেল, কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। জায়গাটা পালটে গেছে কত!”
বৃন্দাবন কাঁপতে কাঁপতে হাতজোড় করে বলল, “আজ্ঞে, আপনি কে? দেবতা না অপদেবতা?”
লোকটা মাটির ওপর নেমে দাঁড়িয়ে তাকে একটু দেখল। তারপর বলল, “আমি জাদুকর গজানন। সদাশিবের বাড়ি কোথায় জানোনা?”
“আ-আজ্ঞে না।”
“তুমি তো চোর। সব বাড়িই তোমার চেনার কথা। আমি যে সদাশিবকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।”
“ও নামে যে কেউ এখানে নেই!”
“ইস! তা হলে যে ভীষণ বিপদ!”
২. ইতিহাসবিত ধর্মনগর
“মহাশয়। ইহাই সেই ইতিহাসবিত ধর্মনগর। এখন দেখিলে বিশ্বাস হয় না যে, এই জনবিরল, বসতিবিরল, শ্বপদসঙ্কুল, আগাছায় পরিপূর্ণ স্থানটিতে সুরম্য হ্যরাজি ছিল, বিশাল দীর্ঘিকাসমূহ, রাজপথ কাননাদিতে সুসজ্জিত এই নগরীর পশ্চিম প্রান্তে পরিখাবেষ্টিত প্রাসাদে রাজা মঙ্গল রায় বাস করিতেন। আজ সবই স্বপ্ন মনে হয়। অনুমান, দুইশতবার্ষিক বৎসর পূর্বের সেই নগর কালের নিয়মেই বিলীন হইয়াছে। আপনার ঊর্ধ্বতন অষ্টম পুরুষ সদাশিব এই নগরীতেই বাস করিতেন।”
গন্ধর্ব হতাশ মুখে সামনের দিকে চেয়ে জায়গাটা দেখছিল। বনবাদাড়, ঢিবি, গর্ত ইত্যাদিতে ভরা এক বিটকেল জায়গা। এখানে ধর্মনগর ছিল বলে বিশ্বাস করা কঠিন। সে একটা হাই তুলল।
শাসন ভট্টাচার্য হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “মহাশয় কি জ্বম্ভন করিলেন?”
গন্ধর্ব জ্বম্ভন মানে জানে না। ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “আজ্ঞে না।”
“ভাল। মহাশয়ের বোধ করি আমার বিবরণ বিশ্বাস হইতেছে না।”
লজ্জা পেয়ে গন্ধর্ব বলে, “আজ্ঞে, ঠিক তা নয়। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। প্রমাণ ছাড়া কিছুই বিশ্বাস করার অভ্যাস নেই। ধর্মনগরের ধ্বংসাবশেষের কিছু চিহ্ন থাকলে ভাল হত। আর আমি ঠিক আমার পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটির সন্ধানেও আসিনি।”
“তাহা আমি জানি। লোকের মুখে শুনিয়াই আপনি একটি কিংবদন্তির পিছনে ঘুরিতেছেন।”
গন্ধর্ব মাথা নেড়ে বলে, “ঠিক তাও নয়। আমি একটা মিথকে ভাঙতে চাইছি।”
শাসন ভট্টাচার্য উদাস মুখে বলল, “ভাঙিয়া কী লাভ? পুরাকালে যেমন, বর্তমানেও সেইরূপ মানুষ নানা আজগুবিতে বিশ্বাস করে। আপনি একটি মিথকে ভাঙিবেন তো আর একটির সৃষ্টি হইবে। আরও একটি ব্যাপার হইল, মিথকে ভাঙা অতীব কঠিন। আপনি বিজ্ঞান ও যুক্তি দিয়া যদিবা ভাঙিলেন, মানুষ আপনাকে পরিহার করিয়া মিথটাকেই আঁকড়াইয়া ধরিবে। আপনি বৃথা শ্ৰম করিতেছেন মহাশয়।”
গন্ধর্ব হতাশভাবে বলে, “হয়তো তাই শাসনবাবু, দেশজোড়া অন্ধ কুসংস্কার, বিদঘুঁটে কিংবদন্তি আর প্রচলিত ভুল ধারণার সঙ্গে লড়াই করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু আমাকে তবু লড়াইটা করতে হচ্ছে নিজের স্বার্থে।”