আচমকা একটা খোলা জানলার পাশে থমকে দাঁড়ায় সে। নীচের তলায় কেউ থাকে না বলে সব জানলাই বন্ধ, শুধু একটাই ভোলা। কাছে গিয়ে সন্তর্পণে ভেতরে উঁকি দিল শাসন। প্রথমে অন্ধকারে কিছুই দেখা গেল না। অন্ধকারটা চোখে একটু সয়ে যাওয়ার পর সে লক্ষ করল ঘরের ভেতরে একটা আরামকেদারা। তার ওপর সামান্য উচ্চতায় শুন্যে ভেসে একজন শুয়ে আছে।
চমকৃত শাসন কিছুক্ষণ নড়তে পারল না। তারপর হঠাৎ তার দু’চোখ ভরে জল এল। সে বিড়বিড় করে বলল, “আমার প্রণাম গ্রহণ করুন হে জাদুকর। আমরা সামান্য মনুষ্য, আপনার মর্ম কী বুঝিব?”
হঠাৎ কয়েকটা হনুমান হুপ-হুঁপ করে গাছে-গাছে লাফঝাঁপ করতে লাগল। চমকে উঠে শাসন যেই পেছন ফিরতে যাবে অমনি একটা ভারী শক্তিমান হাত তার ডান কাঁধের ওপর এসে পড়ল।
একটা চাপা হিংস্র গলা বলল, “এবার কে তোকে বাঁচাবে?”
শাসন ফিরেই রাক্ষসের মুখটা দেখতে পেল।
শাসনের কেন যেন একটুও ভয় হল না। সে পিছু ফিরে লোকটার মুখোমুখি হয়ে চোখের জল হাত দিয়ে মুছে একটু হেসে বলল, “আপনি মেঘনাদবাবু, মাণ্ডুক?”
লোকটা মুখোশের আড়াল থেকে তাকে দেখছিল। বলল, “তাতে তোর কী দরকার?”
“মহাশয়, যেই হউন, আপনি মন্দ লোক। মন্দ লোকেরা তাহাদের কার্যের জন্য শাস্তি ভোগ করিবেই। আপনারও রক্ষা নাই মহাশয়। সময় থাকিতে এখনও সতর্ক হউন, জিঘাংসা পরিহার করুন।”
হনুমানগুলো প্রচণ্ড শব্দ করতে লাগল। কয়েকটা ঢিল এসে পড়ল তাদের আশপাশে।
বিশালদেহী লোকটা হয়তো শাসনকে ছিঁড়ে ফেলত, কিন্তু হঠাৎ জানলার দিকে চেয়ে সে স্থির হয়ে গেল। শাসন ফিরে তাকিয়ে দেখল, জানলায় জাদুকর গজানন এসে দাঁড়িয়েছে। মুখটায় যেন আলো জ্বলছে। বিড়বিড় করে গজানন বলছে, সেই মুখ, সেই চোখ, সেই আকৃতি! রাজা মঙ্গলের মতো। হুবহু। কিন্তু তা কী করে হবে? কী করে হবে?
লোকটা একটা বিশাল রণহুঙ্কার দিয়ে উঠল। তারপর বজ্রগম্ভীর স্বরে বলল, “জাদুকর গজানন!”
ভভারের আলো ফুটিফুটি করছে। কাক ডাকছে। পাখিরা উড়াল দেওয়ার মুখে। হনুমানদের তীব্র চিৎকারে চারদিক মথিত হতে লাগল।
মাণ্ডুক বা মেঘনাদ ফের রণহুঙ্কার দিয়ে বলল, “জাদুকর গজানন, এইবার ঋণ শোধ করো। বহুঁকাল ধরে অপেক্ষায় আছি।”
দুটো প্রবল হাতের টানে জানলাটা ফ্রেম থেকে উপড়ে এনে ফেলে দিল মাণ্ডুক। কোষবদ্ধ তলোয়ার বের করে ফের বজ্রনির্ঘোষে বলল, “এসো কাপুরুষ!”
বাড়ির লোকেরা জেগে দ্রুত নেমে আসছে। ঘুম ভেঙে লোকজন ছুটে আসছে চারদিক থেকে। কাল রায়বাড়িতে ডাকাত পড়ায় তারা সতর্কই ছিল।
জানলা দিয়ে ধীরে বেরিয়ে এল গজানন। ভেসে-ভেসে এল। এসে দাঁড়াল মাণ্ডুকের সামনে। ডান হাতটা তুলে সে বিড়বিড় করে বলল, “না, তুমি মঙ্গল নও।”
“আমি তার বংশধর। রাজা মঙ্গলের ঋণ শোধ নেওয়ার জন্যই আমি জন্মেছি। আমি মাণ্ডুক।”
হতাশায় ভরা মুখে গজানন বলল, “দুই-ই এক। আমার আর ইহজীবনে শান্তি হল না।”
মাণ্ডুক তার তলোয়ারটা তুলে আড়াআড়ি বিদ্যুতের গতিতে চালিয়ে দিল গজাননের গলায়।
গজানন শুধু মাথা নাড়ল। তার গলার ভেতর দিয়ে তলোয়ার চলে গেল বটে, কিন্তু কিছুই হল না।
বিস্মিত মাণ্ডুক ক্ষণেক বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থেকে বিদ্যুৎ গতিতে গজাননকে খণ্ড খণ্ড করে দিতে তরোয়াল চালাতে লাগল।
কিন্তু কিছুই হল না।
এবার তলোয়ার ফেলে মাণ্ডুক লাফিয়ে পড়ল গজাননের ওপর। গলা টিপে ধরল। গজানন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল শুধু। বিস্মিত মাণ্ডুক তার চোখ উপড়ে নেওয়ার জন্য চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দিল। মুগুরের মতো দুই হাতে অজস্র ঘুসি মারল।
চারদিকের লোক প্রথমে ভয়ে চিৎকার করছিল। কিন্তু তারাও বিস্ময়ে চুপ হয়ে গেছে।
মাণ্ডুক হাঁফাচ্ছে। তার চোখ বড় বড়। রাগে তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে।
“মরো গজানন, মরো।”
গজানন শান্ত কণ্ঠে বলে, “আমার কি মরণ আছে?”
“তোমাকে মরতেই হবে!”
মাণ্ডুক কোমর থেকে একটা পিস্তল বের করে গজাননকে পরপর দু’বার গুলি করল। কিছুই হল না। গজাননকে ছুঁয়ে গুলিগুলো গিয়ে পেছনের দেয়ালে বিধল।
হঠাৎ গজাননের চোখে একটা নীল বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল যেন! একটু দুলে সে শূন্যে ভেসে রইল একটুক্ষণ। তারপর সমস্ত শরীরটা হঠাৎ ঋজু হয়ে একটা বল্লমের মতো তীব্রগতিতে গিয়ে পড়ল মাকের ওপর।
মাত্র একবারই। মাণ্ডুক মাটিতে পড়ে একটু ছটফট করে নিথর হয়ে গেল।
গজানন সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর চারদিকে চেয়ে বিস্মিত মুখ আর বিস্ফারিত চোখগুলি দেখল সে। সবাই হাঁ করে তার দিকে চেয়ে আছে।
গজানন মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে বলল, “এর শেষ নেই। এর কোনও শেষ নেই। বারবার শেষ হয়, আবার হয়ও না।”
সে চারদিকে ফের চেয়ে দেখল। তারপর বলল, “চলি বাবারা।”
হঠাৎ পুতুল ছুটে এসে তার হাত ধরল, “কোথায় যাচ্ছ গজাননদাদা? আমার কাছে থাকবে না?”
“না খুকি, আমাকে ঘরে রাখতে নেই।”
“তুমি কোথায় যাবে গজাননদাদা?”
একটু ম্লান হেসে গজানন বলল, “কোথাও কোনও পাহাড়ের গুহায় গিয়ে শুয়ে থাকব, হয়তো কয়েকশো বছর। কে জানে! আবার হয়তো ডাক আসবে। না বাবা, আমি জানি না। আমি জানি না।”
গজানন ধীরে ধীরে হেঁটে, একটু ভেসে-ভেসে চলে যেতে লাগল। ফটক ডিঙিয়ে, মাঠ পেরিয়ে ঢেউয়ের মতো চলে যাচ্ছিল সে। অনেক দূর থেকে একবার হাত তুলল। তারপর হাওয়ায় ভেসে-ভেসে কাটা ঘুড়ির মতো টাল খেতে-খেতে ক্রমশ বিন্দুর মতো ছোট হয়ে গেল। তারপর মুছে গেল যেন। কোনও চিহ্নই আর রইল না তার।