গন্ধর্ব বলল, “শাসনবাবু যে!”
“মহাশয়, এসব কী?”
“কাল রাতে সাংঘাতিক কাণ্ড হয়ে গেছে।”
“মহাশয়, বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করুন।”
গন্ধর্ব ঘটনাটা সংক্ষেপে বিবৃত করে বলল, “গজাননের কৌটোটা আমার মেয়ে যদি বের করে না দিত তা হলে আমাদের সবাইকে কেটে ফেলত লোকটা।”
“মহাশয়, ঘটনাটা সাধারণ নহে। একটি প্রাচীন কৌটার জন্য এত হিংস্রতা অস্বাভাবিক। কিছু বুঝিতেছেন?”
মাথা নেড়ে গন্ধর্ব বলে, “না। কৌটোটার মধ্যে কী ছিল তাও জানি না। লোকটা একবার কৌটোটা খুলেছিল। দুর থেকে মনে হল কালোমতো কী যেন। হিরে-জহরত নয়। কিন্তু আপনাকেই বা এমন ঝোড়ো কাকের মতো দেখাচ্ছে কেন?”
শাসন তার অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে বলল, “মহাশয়, বিপদ এখনও কাটে নাই।”
“কেন ওকথা বলছেন?”
“আমার মনে হইতেছে বাতাসে একটা দ্বৈরথের আয়োজন ও প্রস্তুতি চলিতেছে। ক্ষেত্র প্রস্তুত হইতে আর বিলম্ব নাই।”
“কীসের দ্বৈরথ! কার সঙ্গে কার?”
“এক প্রাচীন কিংবদন্তির সহিত এক জিঘাংসার।”
“এ তো হেঁয়ালি!”
“না মহাশয়, হেঁয়ালি নহে।”
“একটু বুঝিয়ে বলুন।”
“বলিলেও আপনার বিশ্বাস হইবে না। আপনার কন্যাটিকে একবার ডাকিয়া পাঠাইলে ভাল হয়। দুই-একটা প্রশ্ন করিব।”
গন্ধর্ব পুতুলকে ডাকিয়ে আনল। একটু ভয়ে-ভয়ে সে এসে দাঁড়াল।
শাসন তার দিকে চেয়ে হেসে বলল, “তুমি গত রাত্রে সকলের প্রাণরক্ষা করিয়াছ। মা, কৌটাটি তুমি কোথায় পাইলে?”
“সিন্দুকে ছিল।”
“কৌটাটি কাহার, তাহা জানো?”
“জাদুকর গজাননের!”
“কীরূপে জানিলে?”
“শুনেছি।”
“জাদুকর গজানন কে, তা জানো মা?”
“সে একজন ভাল লোক।”
“ভাল লোক! মা, তুমি কি তাহাকে দেখিয়াছ?”
“না তো!”
“তবে কীরূপে জানিলে যে, সে ভাল লোক?”
পুতুল গম্ভীর হয়ে বলল, “আমার মনে হয়।”
“মা, গজানন নামে এক ব্যক্তি এই স্থানে ইতস্তত ঘুরিয়া বেড়ায়। সে সম্ভবত আসল জাদুকর গজানন নহে। সম্ভবত ছদ্মবেশী কোনও অসাধু লোক।”
পুতুল মাথা নেড়ে বলল, “আমি তাকে চিনি না। আমাদের গজানন ভাল লোক।”
শাসন বিস্মিত হয়ে বলে, “তোমাদের গজানন?”
পুতুল জিভ কেটে চুপ করে গেল।
“তোমাদের গজানন কীরূপ? শ্মশ্রুগু আছে কি?”
পুতুল ফিক করে হেসে এক ছুটে পালিয়ে গেল।
শাসন কিছুক্ষণ চিন্তিত মুখে বসে রইল।
গন্ধর্ব বলল, “কী বুঝলেন?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাসন বলল, “মহাশয়, যাহা বলিতেছি তাহা মনোযোগ দিয়া শ্রবণ করুন।”
“বলুন, শুনছি।”
“আমার অনুমান, পুতুল গজাননের সন্ধান জানে। সম্ভবত এই বাড়ির শিশু, বালক-বালিকারা সকলেই জানে। কিন্তু তাহারা কিছুতেই গজাননের সন্ধান আমাদিগকে দিবেনা। মহাশয়, আপনারা দয়া করিয়া প্রাপ্তবয়স্কেরা উহাদের উপর চাপ দিয়া কোনও কথা আদায় করিবার চেষ্টা করিবেন না। শুধু চতুর্দিকে নজর রাখিবেন।”
গন্ধর্ব বলল, “গজাননকে ওরা কোথায় পেল? আমরা তো তার দেখা পাচ্ছি না।”
“এমনও হওয়া বিচিত্র নহে, এই বাড়ির কোনও চোর কুঠুরিতেই সে এখন অবস্থান করিতেছে। কিন্তু মহাশয়, তাহাকে না উত্তেজিত করাই মঙ্গল। শিশুরাই তাহার সহিত যোগাযোগ রক্ষা করুক।”
“বলছেন কী মশাই! যদি সে কোনও জোচ্চোর হয়?”
মাথা নেড়ে শাসন বলল, “না মহাশয়, আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কহিতেছে আপনার শিশুকন্যা ভুল করে নাই।”
“আপনি কি বলতে চান এই গজাননই সেই গজানন? লোকটা দুশো বছর বেঁচে আছে?”
“মহাশয়, যাহা ঘটে তাহা বিশ্বাস না করিবেন কেন?”
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
“তাহা হইলেও কোনও অবিমৃশ্যকারিতা করিবেন না। মনে রাখিবেন মাণ্ডুক এক ভয়ানক ব্যক্তি। তাহার হাত হইতে আমাদের নিস্তার নাই। কারণ, সে গজাননকে না-পাওয়া পর্যন্ত শান্ত হইবেনা। সম্ভবত মাণ্ডকই মেঘনাদবাবু। যদি তাহার হাত হইতে রক্ষা পাইতে চান তাহা হইলে গজাননই একমাত্র ভরসা। কথাটা মনে রাখিবেন।”
“আপনি তো চিন্তায় ফেলে দিলেন মশাই!”
“চিন্তা ও উদ্বেগেরই বিষয়।”
“শাসনবাবু!”
“আজ্ঞা করুন।”
“আমি বলি, আপনার এখন নিজের বাড়িতে থাকাটা নিরাপদ নয়। কাল আপনার বাড়িতে হামলা হয়েছে। আপনি বরং দু-একদিন আমাদের বাড়িতে থাকুন। আমাদের ঘরের অভাব নেই।”
শাসন একটু হাসল, “প্রস্তাবটি উত্তম। আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ, অতিথি হইতে বিশেষ আপত্তি নাই। প্রস্তাবটি গ্রহণ করিলাম।”
শাসনকে নীচের তলার বৈঠকখানায় থাকতে দেওয়া হল। দুপুরে খাওয়ার পর সে বাগানটা দেখতে বেরোল। সঙ্গে গন্ধর্ব।
পেছনের পাঁচিলের কাছে এসে গন্ধর্ব বলল, “পাঁচিলের ওই জায়গায় নাকি গজানন উঠে বসে ছিল। আমার বাবা দেখেছে।”
“এই সু-উচ্চ প্রাচীর, তাহাতে আবার লৌহশলাকা ও কাঁচ প্রোথিত। ইহার উপর কোনও স্বাভাবিক মনুষ্যের উপবেশন অসম্ভব। মহাশয়, লেভিটেশন বলিয়া একটা কথা আছে।”
“জানি। ওসব গাঁজাখুরি।”
“প্রাচীনকালে সাধকরা বায়ুবন্ধন করিয়া শূন্যে কিছুদূর উখিত হইতে পারিতেন বলিয়া শুনা যায়। কত বিদ্যাই চর্চার অভাবে বিনষ্ট হইয়াছে।”
“ওসব বিশ্বাসযোগ্য নয়।” শাসন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আজিকালি কেহই কোনও কথা বিশ্বাস করিতে চাহে না।”
খুব ভোর রাত্রে শাসন চুপিচুপি উঠল। সদর দরজা নিঃশব্দে খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর ধীর পায়ে বাড়িটি পরিক্রমা করতে লাগল। চোখে শ্যেন দৃষ্টি। সে প্রত্যেকটা জানলা লক্ষ করতে করতে এগোচ্ছিল। যদি কোনও আভাস পাওয়া যায়!