খুব খাতির করে লোকটাকে বসালেন নকুড়বাবু। বললেন, “সদাশিব রায় বলে তো এখানে কেউ নেই। তা মশাই, সদাশিবের বাড়ি না থাক, আমার বাড়ি তো আছে, এখানেই থাকুন না হয়।”
লোকটা কেমন যেন বুঝুঁস হয়ে খানিকক্ষণ বসে রইল। তারপর বলল, “তস্য পুত্র-পৌত্র-প্রপৌত্রাদিও কি কেউ নেই?”
“আজ্ঞে, তা তো জানি না, দরকারটা কীসের?”
“খুবই দরকার।”
নকুড়বাবু বললেন, “রায়বাড়ি অবশ্য এখানে একটা আছে। হরিকৃষ্ণ রায়। রথতলা ছাড়িয়ে একটু এগোলেই বাঁ-হাতি বিরাট বাড়ি। তারা সদাশিব রায়ের কেউ হয় কি না তা অবশ্য জানি না। তা আপনি আসছেন কোথা থেকে?”
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “বিশেষ কোনও জায়গা থেকে নয়। আমি ঘুরে-ঘুরেই বেড়াই।”
“তা আপনার নামটি?”
“গজানন, জাদুকর গজানন।”
নকুড়বাবু লাফিয়ে উঠলেন, “গজানন! অ্যাঁ! আরে আপনিই তো তবে গজু কারিগর! কী সৌভাগ্য আমার! কী সৌভাগ্য! এ যে ভাঙা ঘরে চাঁদের উদয়! এ যে কাঙালের ঘরে লক্ষ্মীর আগমন! এ যে লঙ্কায় জয় বাবা হনুমান! না না, এই শেষ কথাটা দয়া করে ধরবেন যেন?”
লোকটার অবশ্য কোনও কথাতেই তেমন গা নেই। চুপচাপ বসে রইল।
নকুড়বাবু ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন, “নিশ্চয়ই পথের ধকল গেছে খুব। আর খিদেটাও নিশ্চয়ই চাগাড় দিয়েছে। দাঁড়ান, ব্যবস্থা করে আসছি।”
কিন্তু লোকটার যেন কোনও ব্যাপারেই তেমন গা নেই। খুব অন্যমনস্ক। ভারী চিন্তান্বিত। কাছেপিঠের কিছুই যেন লক্ষ করছে না। সকালে মুড়ি-শশা-চানাচুর দেওয়া হল, সঙ্গে চা। লোকটা সেসব একটু নাড়াচাড়া করল মাত্র। দুপুরে সামান্য দু-চার গরাস ভাত মুখে দিয়ে উঠে পড়ল।
নকুড়বাবুর স্ত্রী বাসবী দেবী বললেন, “এ কোন কিম্ভূতকে
জোটালে গো! হাঁটাচলা দেখেছ? ঠিক যেন অষ্টাবক্র মুনি।”
নকুড়বাবুর দশ বছরের ছেলে বিলু বলল, “একটু আগে কী দেখলুম জানো? পুকুরে চান করতে নেমে লোকটা মোটে ডুবই দিল না। পুরো শরীরটা ভেসে রইল। যেন শোলার মানুষ। উঠোন থেকে যখন বারান্দায় উঠল তখন দেখলুম বাতাসে ভেসে উঠল।”
নকুড়বাবুও এসব দেখেও দেখেননি। বললেন, “ওঁরা সব গুণী মানুষ।”
বাসবী দেবী চোখ বড় বড় করে বললেন, “ভূতপ্রেত নয় তো গো?”
ধন্দ একটু নকুড়বাবুরও আছে। তবু মাথা নেড়ে বললেন, “ভূত নয়, তবে ভগবানের কাছাকাছি কেউ হবে। কারণ, কাল রাতেই আমি লোকটাকে স্বপ্ন দেখেছি। আমার কাটা ডান হাতটা ফের জোড়া লাগাতেই ওঁর আসা। খুব বড় কারিগর। বেশ যত্নআত্তি করো দেখি।”
“ওমা! যত্নআত্তি করব কী? উনি তো এইটুকু ভাত খান। ভাল করে বিছানা পেতে দিয়েছি, উনি তো মোটে শুলেনই না। আর যে গিয়ে দুটো খোসামুদি কথা বলব তারই বা উপায় কী? উনি তো সর্বদা যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছেন।”
কথাটা ঠিকই যে, জাদুকর গজাননের কোথায় যেন গণ্ডগোল আছে। হাঁটছে না ভেসে বেড়াচ্ছে তা বোঝা যায় না। রাত্রিবেলা নকুড় বাইরের ঘরের চৌকিটাতে বিছানা করে গজাননের শোয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। নিজে শুলেন পাশেই মেঝেতে মাদুর পেতে। এঁরা সব ভগবানের লোক। এঁদের হাওয়া বাতাসেও মানুষের পুণ্যি হয়। কিন্তু মাঝরাতে হ্যারিকেনের সলতে কমানো আবছা আলোয় যা দেখলেন তা অবিশ্বাস্য। দেখলেন, গজাননেন শরীরটা বারবার যেন শূন্যে ভেসে উঠে পড়তে চাইছে, আর গজানন শূন্যে সাঁতার কাটার মতো করে বারবার নেমে আসার চেষ্টা করছে। কিন্তু মানুষ তো গ্যাস-বেলুন নয়! তবে শূন্যে ভাসছে কী করে?
ভয়ে-দুশ্চিন্তায় রাতে নকুড়বাবুর ভাল ঘুমই হল না। তাঁর স্ত্রী ভূতের কথা বলছিলেন। কে জানে বাবা, ঘরে একটা ভূতই ঢুকে পড়ল নাকি?
সকালবেলায় মুখোমুখি চা খেতে বসে নকুড়বাবু বলেই ফেললেন, “আচ্ছা, আপনি আসলে কে বলুন তো? রাত্রিবেলা দেখলুম, আপনি বিছানা থেকে বারবার ভেসে উঠছেন গ্যাস বেলুনের মতো। ভূতটুত নন তো?”
গজানন জুলজুল করে চেয়ে থেকে বলল, “কে জানে বাবা, আমি আসলে কে। তবে ওজনটা বড় কমে গেছে। ওইটেই হয়েছে মুশকিল। যখন-তখন কেন যে ভেসে উঠছি কে জানে!”
“আপনি তো জাদুকর। বলি কুম্ভক-টুম্ভক জানেন নাকি? প্রাণায়ামে নাকি ওসব হয়।”
“জানতুম তো মেলাই। এখন কিছু মনে পড়ে না।”
“আমি বড় আশা করে আছি, আপনার দয়ায় যদি আমার ভাল হাতটা হয়ে যায়।”
গজানন তার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “ডান হাত ছাড়া কি খুব অসুবিধে হচ্ছে?”
“আজ্ঞে, খুব অসুবিধে। ধরুন গামছা নিংড়ানো যায় না, তবলা বাজানো যায় না, হাততালি দেওয়া যায় না।”
“যদি এতকাল চলে গিয়ে থাকে তা হলে বাকিটাও চলে যাবে। কাজ কী ঝামেলা বাড়িয়ে?”
“ঝামেলা কেন বলছেন? হাতটা কি কাজে লাগবে না?”
গজানন মৃদু গলায় বলে, “আমাদের ফটিক ছিল জন্মান্ধ। বেশ চলে যাচ্ছিল তার। হঠাৎ কে একজন কবরেজ এসে তার চোখ ভাল করে দিল। এখন ফটিকের কী মুশকিল! চোখে আলো সহ্য হয় না, রং সহ্য হয় না, যা-ই দেখে তাই তার কাছে কিম্ভুত, অসহ্য মনে হয়। শেষে কান্নাকাটি, চেঁচামেচি। তাই বলছিলুম হাত বাড়ালে হয়তো ঝামেলা বাড়বে।”
এমন সময় প্রতিবেশী গুনেন সরকার এসে হাজির। “শুনলুম তোমার বাড়িতে একজন মস্ত গুনিন এয়েছেন। তাই দেখা করতে এলুম। কতকাল ধরে একজন ভাল গুনিন খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার বেগুনখেতে প্রতি বছর পোকা লাগছে, রাঙা গাইটা দুধ দিচ্ছে না মোটে, মাজার ব্যথাটা সেই যে কচ্ছপের কামড়ের মতো লেগে আছে, আর ছাড়ছেই না। তার ওপর ছেলের বউয়ের সঙ্গে তার শাশুড়ির নিত্যি ঝগড়া লাগছে, বাড়িতে তিষ্টনো যাচ্ছে না। কদম বিশ্বেসের সঙ্গে মামলাটা এখনও ঝুলে রয়েছে…”