পেছন থেকে মাঝে-মাঝে জোরালো টর্চের আলো এসে পড়ছে এদিক-সেদিকে। ওরা টের পেয়েছে যে, সে আমবাগানে ঢুকেছে। এবার ওরা চারধারে ছড়িয়ে পড়ে তাকে খুঁজবে। খুব সহজে রেহাই পাবে না শাসন। প্রাণভয়ে সে ফের ছোটার চেষ্টা করল। দু’বার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল সে। কিন্তু দমে গেল না। এগোতে লাগল।
হঠাৎ ‘বাপ রে’ বলে একটা চিৎকার শোনা গেল পেছন থেকে। আর-একজন চেঁচিয়ে বলল, “গাছ থেকে কে যেন ঢিল মারছে হুজুর।”
গম্ভীর গলাটা বলল, “গাছে তাক করে গুলি চালাও।” দুম করে একটা গুলির শব্দ হল। সেইসঙ্গে হনুমানদের হুপ-হুঁপ শব্দ আসতে লাগল।
এই সুযোগে অনেকটাই এগিয়ে গেল শাসন। কে ঢিল মারল তা বুঝতে পারছে না। হনুমানগুলোই কি? এরকম তো হওয়ার কথা নয়!
হাঁটতে হাঁটতে আর দৌড়তে দৌড়তে সে যখন আমবাগানটা পেরিয়ে খোলা জায়গায় পা ফেলল, তখন ভোর হয়ে আসছে। এবং সে ধর্মনগর শিবাইতলার গঞ্জে পৌঁছে গেছে। সামনেই গন্ধর্বদের বাড়ি।
৭. পুলিশ এসেছে
শেষ রাতে পাড়াপ্রতিবেশীরা এসে জড়ো হয়েছে, পুলিশ এসেছে। বাড়ি গিজগিজ করছে লোকে। মন্মথ ডাক্তার এসে হরিকৃষ্ণের ক্ষতস্থান ধুইয়ে ওষুধ লাগিয়ে নতুন করে ব্যান্ডেজ বাঁধছে। সকলেই আতঙ্কিত।
এই গণ্ডগোলে পুতুল আর অবু চুপিসারে নীচে নেমে এসে গজাননের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। পুতুলের হাতে একটা ডল পুতুল।
“গজাননদাদা!”
“কী বাবা?”
“তুমি জেগে আছ?”
“হ্যাঁ বাবা, আমার ঘুম আসছে না।”
“তুমি তো জানো না গজাননদাদা, আমাদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল।”
গজানন ধীরে ধীরে আরামকেদারায় উঠে বসল। বলল, “জানি বাবা। আমার দুতেরা আমাকে খবর দিয়ে গেছে।”
পুতুল কান্না চাপতে-চাপতে বলল, “কর্তাবাবাকে, দাদুকে, আমার বাবা আর জ্যাঠাকে খুব মেরেছে। কর্তাবাবাকে ছুরি মেরেছে, গলাও কাটতে যাচ্ছিল।”
গজানন মাথা নেড়ে বলল, “হায় হায়! তোমাদের বড় বিপদ হল তো!”
“হ্যাঁ গজাননদাদা। আমার খুব কান্না পাচ্ছে। ওরা ভীষণ খারাপ লোক।”
অবু বলল, “গজাননদাদা, ওরা কেন এসেছিল জানো? তোমার সেই কৌটোটা কেড়ে নিয়ে যেতে।”
গজানই মাথা নেড়ে বলল, “হায় হায়। সেটা গেলে আমার আর কিছু করার থাকবে না! আমি যে বড় দুর্বল হয়ে যাব।”
“কৌটোটা ওরা নিয়ে গেছে গজাননদাদা।” গজানন ফের ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ল। বলল, “তা হলে আমার আর কিছু করার নেই। কিছু করার নেই।”
অবু বলল, “কেন গজাননদাদা, তোমার কী হবে?”
গজানন মৃদুস্বরে বলে, “জানি না বাবা। আমার কৌটোটার জন্য তোমাদের কত বিপদ গেল। তোমরা কত কষ্ট পেলে।”
পুতুল এক-পা এক-পা করে কাছে গিয়ে গজাননের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “শোনো গজাননদাদা, আমরা কিন্তু বোকা নই। আমরা আন্দাজ করেছিলাম তোমার কৌটোটা আমাদের স্টোর রুমের সিন্দুকেই আছে। কারণ পুরনো জিনিসপত্র সব ওখানেই থাকে। তাই আমি আর মেজদা মিলে বুদ্ধি করে গভীর রাতে উঠে কর্তাবাবার তোশকের তলা থেকে চাবি নিয়ে গিয়ে সিন্দুক খুলি। তোমার কৌটোটা একটা পুরনো পুঁথির সঙ্গে লাল শালুতে জড়ানো ছিল। কৌটোটা আমি এনে আমার পুতুলের বাক্সে লুকিয়ে রেখে দিই। ভেবেছিলাম সকালে তোমাকে এনে দেব। কিন্তু মাঝরাত্রে ডাকাত পড়ল। আমরা ঘুম ভেঙে উঠে দেখলাম ডাকাতরা সবাইকে কীরকম নিষ্ঠুরভাবে মারছে। কৌটোটার জন্য ওরা আমাদের সবাইকে কেটে ফেলবে বলেও ঠিক করেছিল। তখন আমি গিয়ে কৌটোটা বের করে ওদের দিয়ে দিই।”
“ভালই করেছ বাবা। প্রাণের চেয়ে তো আর কৌটোটা বড় নয়!”
“না গজাননদাদা, আমি অত বোকা নই। আমি তার আগে কৌটোটা খুলে ফেলি। দেখি তার মধ্যে তোমার কালো নস্যির গুঁড়ো রয়েছে। আমার একটা ফাঁপা পুতুল আছে, যার মুণ্ডুটা ঘোরালে খুলে যায়। ভেতরটা কোটোর মতো। আমি পুতুলের ভেতরে গুঁড়োটা ঢেলে নিই। তারপর ঠাকুমার কালো মাজনের খানিকটা কৌটোয় ভরে মাণ্ডুককে দিয়ে দিই। সে একটুও বুঝতে পারেনি।”
গজানন উজ্জ্বল হয়ে বলল, “তোমার আশ্চর্য বুদ্ধি বাবা!”
ডল পুতুলটা বাড়িয়ে দিয়ে পুতুল বলল, “এই নাও তোমার নস্যি।”
পুতুলটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসে রইল গজানন। তার মুখে এক আশ্চর্য আলো ফুটে উঠল। সেই আলোয় দেখা গেল, তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।
“তুমি কাঁদছ কেন গজাননদাদা?”
“একটা দুষ্ট লোকের জন্য কাঁদছি। সে কিছুতেই ভাল হতে চায় না। তাকে আমি মারতে চাইনি কখনও। কিন্তু কী যে করি!”
“কেঁদো না গজাননদাদা। তোমার নস্যি তো পেয়ে গেছ। আমাদের কাছে থাকো। আমরা তোমাকে খুব ভালবাসব।”
“জানি বাবা, জানি। তোমরা বড় ভাল। কিন্তু দুষ্টু লোকটা কি তোমাদের শান্তিতে রাখবে? খুঁজতে খুঁজতে সে এল বলে!”
“সে কি আবার আসবে?”
“হয়তো আসবে। কে জানে কী হবে!”
“এই দুষ্ট লোকটার নাম মাণ্ডুক। তুমি ওকে চেনো?” মাথা নেড়ে গজানন বলে, “না বাবা, চিনি না। কিন্তু সে ভাল লোক নয়। তার বুকে মায়াদয়া নেই, শুধু জ্বালা আছে।”
পুতুল কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “সে যদি আবার এসে আমাদের মারে?”
“না বাবা, সে তোমাদের মারবে না। সে এবার আর একজনকে মারবে। তোমরা গিয়ে ঘুমোও, নিশ্চিন্তে ঘুমোও।”
.
শাসন হাঁফাতে হাঁফাতে এসে যখন পৌঁছল তখন রায়বাড়ির ভিড় পাতলা হয়ে গেছে। দু-একজন ছাড়া কেউ নেই। সদর দরজা ভাঙা দেখে বিস্মিত শাসন ওপরে উঠে চারদিকে অবস্থা দেখে বুঝল কী হয়েছে।