গজানন জানলার কাছে বসে নিবিষ্ট হয়ে তাদের কথা শুনছিল। তারপর সেও কয়েকটা বিচিত্র শব্দ করল। হনুমানেরা ধীরে ধীরে চুলে গেল।
মাঝরাতে শাসন একটা শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙে উঠে বসল। রাতের কিছু চেনা শব্দ আছে। কুকুর বা শেয়ালের ডাক, বাদুড়-প্যাঁচার শব্দ, ইঁদুরের শব্দ, আরশোলার ফরফর, জীবজন্তুদের দৌড়োদৌড়ি, গাছে বাতাসের শব্দ, দূরের পেটা ঘড়ির আওয়াজ। কিন্তু এটা সেইসব চেনা শব্দ নয়। এত সূক্ষ্ম একটা খসখসে আওয়াজ যে, শুনতে পাওয়ার কথাই নয়!
শাসন উঠে বসে শব্দটা ফের শোনার চেষ্টা করছিল। ইন্দ্রিয়গুলি সজাগ। গায়ে হঠাৎ কেন যেন কাঁটা দিচ্ছিল তার। সেদিন কে যেন তার মাথা লক্ষ্য করে একটা কামানের গোলা ছুঁড়ে মেরেছিল। সে-ই আবার এল না তো কাজটা সমাধা করতে? সে গরিব মানুষ। নিতান্তই দীনদরিদ্র একটা টালির চাল আর বাঁশের বেড়ার ঘরে থাকে। দরজা জানলা মোটেই মজবুত নয়। একটা লাথি মারলেই ভেঙে পড়বে। এ ঘরে নিরাপত্তা বলে কিছু নেই।
শাসন তার চৌকি থেকে নেমে দরজার কাছে গিয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, বাইরে কোনও সন্দেহজনক শব্দ শোনা যাচ্ছে কি না। কিছু শুনতে না পেয়ে সে দরজার তক্তার ফাঁকে চোখ রেখে দেখার চেষ্টা করল। ভাগ্য ভাল, বাইরে একটু জ্যোৎস্নার আলো আছে। সামান্য ফাঁক দিয়ে সে বারান্দা আর উঠোনের একচিলতে অংশ আবছা দেখতে পাচ্ছিল। সেখানে কেউ নেই। তবু সে নিবিষ্ট চোখে তাকিয়ে রইল।
হঠাৎ একটা ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে এসে তার উঠোনে দাঁড়াল। বিশাল চেহারা, গায়ে কালো পোশাক, মুখে মুখোশ। একটা ক্ষীণ শিসের শব্দ হল। আরও কয়েকজন উঠোনে এসে ঢুকল।
প্রত্যেকেরই চেহারা খুব শক্তপোক্ত। প্রত্যেকের মুখেই মুখোশ।
শাসনের পালানোর কোনও রাস্তা নেই। এরা যে ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি তাও সে বুঝতে পারছে। কিন্তু আত্মরক্ষার কোনও উপায় আপাতত সে দেখতে পাচ্ছে না। তবে কিনা দীর্ঘকাল বিপদ-আপদের সঙ্গে বসবাস করার ফলে সে চট করে বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে না। কৌশল ছাড়া এই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা যে শক্ত, তা বুঝতে হঠাৎ সে এক দুঃসাহসী কাজ করে ফেলল।
হুড়কো খুলে দরজার কপাট সরিয়ে সে দাওয়ায় বেরিয়ে এসে হাত জোড় করে অত্যন্ত বিনীতভাবে বলল, “মহারাজের জয় হউক।
এই দীনের কুটিরে পদার্পণ করিয়াছেন। আমি ধন্য।”
বলেই শাসন একটা আভূমি অভিবাদন করে ফেলল।
তার এরকম আচরণে লোকগুলো একটু থমকে গেছে।
সামনের বিশাল পুরুষটি বজ্রগম্ভীর গলায় বলল, “তুই কে?”
“শ্রীমন্মহারাজাধিরাজ, আমি এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ। পূজার্চনাদি করিয়া উদরান্নের সংস্থান করিয়া থাকি।”
“আমি কে, তা তুই জানিস?”
শাসন জানে না। কিন্তু তার মন বলছিল, এই লোকটা বিষাণ দত্তের সেই মেঘনাদবাবু হলেও হতে পারে। নিতান্তই অনুমান। তবে বিদ্যুৎ-চমকের মতো হঠাৎ তার মাথায় একটা নাম খেলে গেল।
সে হাঁটু গেড়ে বসে অতি বিনীতভাবে বলল, “ধর্মনগরের অধিপতি মহারাজ মঙ্গলকে আমার আনুগত্য জানাইতেছি।”
লোকটা হঠাৎ এগিয়ে এসে বজ্রমুষ্টিতে তার চুলের মুঠি ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “কে বলেছে যে, আমি রাজা মঙ্গল?”
প্রবল সেই ঝাঁকুনিতে শাসনের মনে হল তার মুণ্ডুটা বোধ হয় ধড় থেকে আলাদা হয়ে যাবে।
শাসন ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, “ক্ষমা করুন মহারাজ, আমার ভ্রম হইয়াছে।”
লোকটা অবশ্য তাকে ছাড়ল না। আর-একটা ঝাঁকুনিতে তার ঘাড়ের হাড় প্রায় আলগা করে দিয়ে বলল, “সব ব্যাপারে নাক গলাতে তোকে কে বলেছে?”
ব্যথায় শাসনের চোখে জল এল। সে বলল, “আর এইরূপ হইবে মহাশয়, বাক্য প্রদান করিতেছি।”
লোকটা তাকে হাতের ঝটকায় দাওয়ার ওপর ফেলে দিল। তারপর একজন সঙ্গীকে বলল, “আমার খঙ্গটি দাও।”
লোকটা একটা ঝকমকে খাঁড়া এগিয়ে দিল। লোকটা খাঁড়ার ধারটা একটু পরীক্ষা করে নিয়ে এগিয়ে এল।
শাসনের একটি গুণ আছে। সে হরিণের মতো দৌড়তে পারে। সে পড়ে গিয়েই ভেবে নিয়েছিল, যদি সে উঠে ছুট লাগায় তবে এইসব ভারী চেহারার লোকেরা তার নাগাল পাবে না। কিন্তু উঠে দৌড় লাগানোর জন্যও একটু সময় দরকার। সেই সময়টুকু পাওয়া যাবে কি?
লোকটা খাঁড়া হাতে দাঁড়িয়ে একজনকে বলল, “ওর মাথাটা ধরো।”
একটা লোক এগিয়ে এল। একটু সুযোগ। ঘাড়ে অসহ্য ব্যথা আর মাথার ভেতরে একটা ডোম্বল ভাব সত্ত্বেও নিতান্ত জৈব প্রাণরক্ষার তাগিদে সে প্রায় অন্ধের মতো হঠাৎ শরীরটা গড়িয়ে এক ঝটকায় উঠোনে পড়ে গেল। পড়েই সে এগিয়ে-আসা লোকটার একটা ঠ্যাং ধরে হ্যাঁচকা টান দিতেই লোকটাও বিশাল একটা গাছের মতো দড়াম করে পড়ল উঠোনে। একটা ‘রে রে’ শব্দ করে উঠল সবাই। শাসন একটা লাফ দিয়ে খানিকটা তফাতে গিয়েই উঠোনের বেড়াটা ডিঙিয়ে নক্ষত্ৰবেগে ছুটতে লাগল। টের পেল পেছনে পেছনে লোকগুলো ভারী পা ফেলে দ্রুত ছুটে আসছে।
দিগ্বিদিক খেয়াল না করেই শাসন ছুটতে ছুটতে ডানধারে অন্ধকার আমবাগানটার মধ্যে ঢুকে পড়ল। আমবাগানে চট করে লুকিয়ে পড়া যায়। সহজে ধরতে পারবে না।
সে অন্ধকার বাগানটায় ঢুকতেই কয়েকটি হনুমান হুপ-হুঁপ করে যেন উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল। এ-সময়ে ওদের চেঁচামেচি করার কথা নয়। শাসন তাড়াতাড়ি গাছের আড়ালে আড়ালে খানিক দৌড়ে, খানিক হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছিল। যতখানি সম্ভব ওদের কাছ থেকে দূরে যাওয়া দরকার। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছে বটে, কিন্তু বিপদ এখনও কাটেনি।