- বইয়ের নামঃ গজাননের কৌটো
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. মঙ্গলেশ্বরী অস্ত্রোপচার কেন্দ্র
গজাননের কৌটো – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
দোকানের বাইরে মস্ত সাইনবোর্ড ‘মঙ্গলেশ্বরী অস্ত্রোপচার কেন্দ্র’, নীচে লেখা—“এখানে অতি সুলভে কাটা হাত, পা, মুণ্ডু ইত্যাদি যত্ন সহকারে নিখুঁতভাবে জুড়িয়া দেওয়া হয়। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।”
দোকানের ভেতরে রমরম করছে ভিড়। লম্বা একটা হলঘরে বেঞ্চে বসে আছেন হাতকাটা নকুড়বাবু। হলঘরের অন্য প্রান্তে একটা লম্বা অপারেশন টেবিলের ওপরে বুকে কাটা হাত, পা, মুণ্ডু জুড়ে যাচ্ছে একটা দাড়িগোঁফওলা লোক। ভীষণই ব্যস্ত। তাকে ঘিরে মেলা লোক “আমারটা আগে করে দিন দাদা, আমাকে আগে ছেড়ে দিন দাদা” বলে কাকুতি মিনতি করছে। লোকটা খুব একটা ভূক্ষেপ করছে না। শুধু বলে যাচ্ছে, “হবে রে ভাই হবে, একটু সবুর করো। এক-এক করে সবাইকেই মেরামত করে দেব।”
নকুড়বাবুর পাশে একটা লোক নিজের কাটা মুণ্ডুটা দু’হাতে বুকে চেপে ধরে বসে আছে। মুণ্ডুটা পিটপিট করে চারদিকে চাইছিল। নকুড়বাবুকে বলল, “বুঝলেন মশাই, গজু কারিগরের হাতটি বড় ভাল। কিন্তু খদ্দেরের ভিড়ে লোকটা হিমসিম খাচ্ছে।”
নকুড়বাবু বললেন, “তাই দেখছি। তা আপনার মুণ্ডু কাটা গেল কীভাবে?”
“সে আর বলবেন না। রাতের খাওয়া শেষ করে সবে পায়েসের বাটিতে হাত দিয়েছি, এমন সময় বাড়িতে ডাকাত পড়ল। আমি তবে রে’ বলে যেই লাফিয়ে উঠেছি অমনি ফ্যাচাং।”
“আচ্ছা।”
“মুণ্ডু কাটা পড়লে বড় অসুবিধে মশাই। খাওয়া দাওয়াই বন্ধ।”
“তা বটে।”
“দেখি, যদি আজকেই গজু জুড়ে দেয়, তবে বিকেলে ভাল খ্যাঁট চালিয়ে দেব।”
ওদিকে একটা লোক খুব চেঁচামেচি লাগিয়েছে, “এটা তোমার কেমন আক্কেল বলল তো গজুদা! ভুল করে আমার মুণ্ডু বাঞ্ছারামের ধড়ের সঙ্গে জুড়ে দিলে! ছিঃ ছিঃ। আমি হলুম ফরসা আর বাঞ্ছারাম হাকুচ কালো। তার ওপর বাঞ্ছারামের কোমরে দাদ আছে। বলি কি, চোখের মাথা খেয়েছ নাকি?”
গজু ওস্তাদ মোলায়েম গলায় সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “ওরে, অমন চেঁচাসনি, এক হাতে এত কাজ করলে একটু আধটু ভুলচুক কি আর হতে নেই! আজ বাড়ি যা, সামনের সপ্তাহে আসিস, ধড় বদলে দেবখন।”
“না না, সে হবে না, আমার ধড়টাই আমার চাই।”
“আহা, তোর ধড় এখন খুঁজে দেখবে কে? কোন মুণ্ডু তোর ধড়ে চেপে চলে গেছে কে জানে? সে যদি ফেরত দিতে আসে তখন দেখা যাবে। একা হাতে কাজ, সামলানো মুশকিল।”
“তোমাকে কবে থেকে বলছি টিকিট সিস্টেম করো, টিকিট সিস্টেম করো, তা কথাটা কানেই তুলছ না। ধড়ে আর মুণ্ডুতে নাম ঠিকানা লেখা টিকিট সেঁটে রাখলে তো আর ভুল হয় না।”
“হবে রে বাপু, হবে। একটু সবুর কর, সব হবে।”
হঠাৎ আর একটা লোক পিছু হেঁটে দোকানে ঢুকে চেঁচিয়ে বলল, “এটা কী করলে গজুদা?”
গজু খুব স্নেহের গলায় বলল, “কেন, তোর আবার কী হল?”
লোকটা খাপ্পা হয়ে বলল, “দেখছ না, কী কাণ্ড করেছ?”
নকুড়বাবু দেখলেন লোকটার মুণ্ডু পেছনদিকে ঘোরানো। চোখ, নাক, মুখ, সব পেছনদিকে।
লোকটা বলল, “অজ্ঞান করে মুণ্ড জুড়েছ। তারপর ঢাকাঁচাপা দিয়ে আমার ছেলেরা আমাকে বাড়ি নিয়ে গেছে। জ্ঞান হয়ে দেখছি এই কাণ্ড। চোখ পেছনে বলে সামনের দিকে হাঁটতে পারছি না। খেতে গেলে কাঁধের ওপর দিয়ে হাত ঘুরিয়ে মুখে গরাস দিতে হচ্ছে, তাও ঠিকমতো মুখে যাচ্ছে না। লোকের সঙ্গে পিছু ফিরে কথা কইতে হচ্ছে। ভীমরতি হল নাকি তোমার?”
নকুড়বাবুর বাঁ পাশে বসা একজন বুড়োমানুষ বলে উঠলেন, “ভীমরতি ছাড়া আর কী? এই তো আমার দুটো কাটা হাত জুড়তে গিয়ে বাঁ হাত ডান হাতের জায়গায় আর ডানটা বাঁয়ের জায়গায় জুড়েছে। কী যে কাণ্ড করে গজু মাঝে মাঝে! তবে হ্যাঁ, দু-চারটে গণ্ডগোল করলেও ওর মতো কারিগর নেই। এমন জুড়বে যে, কখনও কাটা গিয়েছিল বলে মনেই হবে না। তা মশাই, আপনার কেসটা কী?”
নকুড়বাবু করুণ গলায় বললেন, “ছেলেবেলায় সেপটিক হয়ে হাতে পচন ধরায় ডাক্তাররা নুই অবধি কেটে বাদ দিয়েছিল। তা সেই হাতের জন্যই আসা।”
“অ। তা একটা হাত কি জোগাড় করে এনেছেন?”
“না তো?”
“তা হলেই তো মুশকিল। হাত একখানা জোগাড় করে আসলে ভাল হত। গজুর কাছে অবিশ্যি হাত পাওয়া যায়। দামটা একটু বেশি পড়বে আর সব বেওয়ারিশ হাত। লাগালে অসুবিধে হতে পারে। হয়তো চোর-ছ্যাঁচড় বা খুনে-গুণ্ডার হাত, কিংবা পকেটমারেরও হতে পারে। তখন দেখবেন হাত সামলানো মুশকিল হবে। আপনি হয়তো চান না তবু আপনার হাত হয়তো কারও জিনিস চুরি করল বা কাউকে হঠাৎ খুন করেই বসল কিংবা কারও পকেট থেকে মানিব্যাগ তুলে নিল।”
“ও বাবা! তা হলে কী হবে?”
এই স্বপ্ন দেখে মাঝরাতে ধড়মড় করে উঠে বসেছিলেন নকুড়বাবু। তারপর তাঁর আর ঘুম হয়নি। আর কী আশ্চর্য কাণ্ড! সকালবেলাতেই একটা দাড়িগোঁফওয়ালা লোক এসে হাজির হল।
“মশাই, সদাশিব রায়ের বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?”
নকুড়বাবু জবাব দেবেন কি, হাঁ করে লোকটার মুখের দিকে চেয়ে আছেন। এ যে স্বপ্নে দেখা গজু কারিগর! সেই মুখ, সেই দাড়িগোঁফ! এ কি ভগবানেরই লীলা! গজু কারিগর সশরীরে তাঁর বাড়িতে! তা হলে কি তাঁর ডান হাতের দুঃখ এবার ঘুচবে?