কথাটা কানে যেতেই দিনু বলল, “সর্বনাশ! হাত বলি দিলে যে সব ভেস্তে যাবে!” বলেই সে উঠতে যাচ্ছিল।
মুশকো লোকটা তাকে একটা থাবড়া মেরে বসিয়ে দিয়ে বলল, “গল্পটা বেশ কেঁদেছ বাপ। ভেবেছ পাগল সেজে আমার হাত থেকে রেহাই পাবে? অত সহজ নয়। আমার একটা দোষ হল, পুরনো কথা মনে থাকে না। যতক্ষণ তোমার ওই চাঁদবদনটি কোথায় দেখেছি তা মনে না পড়ছে, ততক্ষণ তোমাকে সরে পড়তে দিচ্ছি না। এখন বলো তো কোথায় তোমাকে দেখেছি!”
দিনু অতিশয় নরম গলায় বলল, “পাগলা গারদেই দেখে থাকবেন। সেখানে রোজ কত বড় বড় মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হত। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, বোম্বাই ছবির হিরো।”
মুশকো লোকটা মশালটা দিনুর মুখের আরও কাছাকাছি এনে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল, “উঁহু, অত সোজা পাত্তর তুমি নও।”
দিনু মুখটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “মুখটা যে পুড়িয়ে ফেলবেন মশাই। পোড়া মুখ লোককে দেখাব কী করে?”
মুশকো লোকটা একটু হেসে বলল, “কিন্তু তোমাকে যে চিনে ফেলেছি বাছাধন! তুমি একসময়ে শশীবাবুর বাড়ির ভৃত্য ছিলে না? চুরিটুরি করে বদনাম করেছিলে। শশীবাবু তোমাকে ঘাড় ধরে বের করে দেয়। ঠিক কি না?”
দিনু ভারি লজ্জিত হয়ে বলল, “আজ্ঞে, ঠিকই বলেছেন। শশীবাবুর বাড়িতেই প্রথম হাতেখড়ি। তারপর অবশ্য বিদ্যেটা আর বেশিদূর এগোয়নি। আপনাদের কাছে তো শিখতেই আসা। এখানে মেলা গুণিজন আজ আসবেন জেনে চলে এসেছি। ভাল ওস্তাদ পেলে নাড়া বেঁধে ফেলব।”
লোকটা হাঃ হাঃ করে হেসে উঠে সবাইকে বলল, “ওরে, এখানে এক মস্ত মানুষ এসেছে আজ। এর পানে একটু তাকা।”
সবাই তার দিকে তাকাতেই দিনু হাতজোড় করে বলল, “আজ্ঞে আমি তুচ্ছ মানুষ। আপনারা ব্যস্ত হবেন না।”
মুশকো লোকটা বলল, “এ শশীবাবুর ভৃত্য ছিল। এতক্ষণ বসে বসে কাকে মন্ত্রী করবে, কাকে সেনাপতি করবে, এইসব নিয়ে কথা বলছিল। ধরা পড়ে পাগল সাজছে।”
কে একজন বলে উঠল, “ব্যাটা শয়তান! গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছে।”
ভীম দাস বজ্রগম্ভীর গলায় বলল, “নিয়ে আয় তো ধরে। মা বহুকাল মানুষের রক্ত পায়নি। আজ ওটাকে উচ্ছুরু করে নরবলি দিয়ে দিই।”
রে-রে করে গোটাদশেক লোক ধেয়ে এল তার দিকে। দিনু অবশ্য উত্তেজিত হল না। হাসি-হাসি মুখ করে বসে রইল।
ঝিকু বলল, “পালাও দিনুদা।”
দিনু বলল, “দাঁড়া না। কেরানিটা দেখি একটু।”
অত লোক এসে যখন হামলে পড়ল দিনুর ওপর, তখনই দিনুর এলেম বোঝা গেল। ওই হাত-পা-শরীরের ভিড়ে বেঁটে দিনু যেন তালগোল পাকিয়ে একখানা বলের মতো একটা ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে গেল শুধু। যখন উঠে দাঁড়াল, তখনও হাতচারেক দূরে সবাই মিলে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। একটু হাসল দিনু, তবে আর দাঁড়াল না। একটু জোর পায়ে হাঁটা দিল।
রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ ঘরেজমশাইয়ের জানলায় একটু ঠুকঠুক শব্দ হল। নন্দ কবিরাজ জেগেই ছিলেন। এসে জানলা খুলে দিয়ে বললেন, “আমার নাতি কেমন আছে, সত্যি কথা বলো।”
“আজ্ঞে, আমরা সত্যি কথা বললেও কেউ বিশ্বাস করে না। সেই দুঃখে সত্যি কথা বলা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। তবু আজ আপনাকে একটা সত্যি কথাই বলার চেষ্টা করছি, আপনিও বিশ্বাস করার চেষ্টা করুন। আপনার নাতি ভালই আছে। খুব ভাল। এমন কি, সে বাড়ি আসতেই চাইছে না।”
“মিথ্যে কথা।”
“ওই দেখুন, যা বলেছিলাম সত্যি কি না। আমরা সত্যি কথা বললেও কোনও লাভ হয় না।”
“হাতটা পেলেই তাকে ফেরত দেবে তো?”
দিনু ভারি বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আজ্ঞে, সে তো বটেই। তবে কিনা ওইসঙ্গে শশীবাবুর ব্যাপারটাও মিটিয়ে ফেললে বড্ড ভাল হয়।”
“শশীবাবুর কী ব্যাপার?”
“ওই যে কথায় বলে, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। তা, শশীবাবুর শ্বাস যতক্ষণ চলছে ততক্ষণ আমাদের আশা নেই। তাই বলছিলাম তাঁর একটা বিলিব্যবস্থা হয়ে যাক, তারপর নাতি।”
“তা হবে না। হাতটা এনে দিতে পারি, তার বিনিময়ে বাবলুকে অক্ষত শরীরে ফেরত দিতে হবে।”
দিনু মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে, তা হয় না।”
“কেন হয় না?”
“শশীবাবু যদি বেঁচে ওঠেন, তা হলে আমার বিপদ আছে। হাত যেখানে যার কাছেই থাকুক, শশীবাবুর হুকুম তামিল করবে। কাজেই উনি বেঁচে থাকতে হাত দিয়ে আমাদের লাভ হবে না মশাই।”
“তা হলে?”
“আমার আর-একটা কথাও আজ আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে। সেটা হল, হাতটা যদি আমাকে হস্তান্তর নাও করেন, তা হলেও রক্ষা করতে পারবেন না। ওই হাত কালই গুণ্ডা বদমাশরা ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে নষ্ট করে ফেলবে। আমার কাছে পাকা খবর আছে।”
“আমার নাতির পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। তার মা, ঠাকুমা, বাপ, কাকা, পিসি সবাই কান্নাকাটি করছে। তোমার কি মায়াদয়া নেই বাপু?”
“খুব আছে কবরেজমশাই, খুব আছে। তাকে তো আমি পুষ্যি নিয়েই ফেলেছি প্রায়। ছেলেটাও বড্ড মিষ্টি। ফেরত দিতে আমার কষ্ট হবে।”
নন্দ কবিরাজ একটু ফুঁপিয়ে উঠে বললেন, “তাকে যদি কষ্ট দাও, তা হলে তোমার ভাল হবে না।”
“চিন্তা করবেন না। সে তোফা আছে। কাল সকালেই হাতটা একটু হাত-সাফাই করে নিয়ে আসুন। রাত্রিবেলা আমি এসে নিয়ে যাব। তারপর মাত্র কয়েকটা দিন। শশীবাবু পটল তুললেই নাতি ফেরত পাবেন।”
“ভগবানের নামে দিব্যি করে বলো।”
“ভগবান! তাঁর নামে দিব্যি করে কী হবে? কথা না রাখলেও ভগবানের গায়ে আঁচড়টিও পড়বে না।”