আর-একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নন্দ কবিরাজ বললেন, “বুঝেছি।”
সদাশিববাবু একটু গলা নামিয়ে বললেন, “শশীবাবুর জন্য যে নতুন ওষুধটা তৈরি করছেন, তার কতদূর?”
নন্দ কবিরাজ একটু বিষয় গলায় বললেন, “গাছগাছড়া জোগাড় হচ্ছে।”
“তাড়াতাড়ি করে ফেলুন। গতিক মোটেই সুবিধের নয় কিন্তু।”
গতিক যে সুবিধের নয়, তা নন্দ কবিরাজের চেয়ে ভাল আর কে জানে! দারোগাবাবু বিদায় হলে নন্দ কবিরাজ শশীবাবুকে দেখতে গেলেন। আজ ঘরে ঢুকে তাঁর চোখ প্রথমেই গিয়ে পড়ল হাতটার ওপর। শশীবাবুর খাটের পাশেই টেবিলের ওপর হাতটা রাখা। শশীবাবুর মতোই নির্জীব। শশীবাবুকে পরীক্ষা করার পর নন্দবাবু আজ সাহস করে হাতটা তুলে একটু দেখলেন। একটু নাড়াচাড়া করলেন।
ক্ষান্তমণি বলল, “বাবার একটা মন্ত্র আছে। সেটা না বললে হাতটা কাজ করে না।”
নন্দ কবিরাজ কথাটা শুনতে পেলেন না। হাতটার দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। এই হাতটার ওপর তাঁর নাতির প্রাণ নির্ভর করছে। কী করবেন তা বুঝতে পারলেন না। মনটা বড্ড ভার হয়ে আছে। এই হাতটা তাঁকে চুরি করতে হবে। তারপর বদমাশদের হাতে তুলে দিতে হবে। ভাবতেও গা শিউরে ওঠে ঘেন্নায়। কিন্তু বাবলুর জন্য একাজ না করেই বা উপায় কী?
৩. ভীম দাসের গলা
বক্তৃতার শেষদিকে ভীম দাসের গলা আবেগে কাঁপতে লাগল। সে বলল, “ভাইসব, এই কুঞ্জপুকুর, হরিহরপুর, বেলডাঙা, চরণডাঙা, সোনাডিহি, নায়েবগঞ্জ ইত্যাদি জায়গায় বরাবরই বাংলার সুসন্তানরা জন্মগ্রহণ করেছেন। মনে রাখবেন এখানে কালু সদারের মতো প্রাতঃস্মরণীয় ডাকাত, গোপাল গায়েনের মতো চিরস্মরণীয় চোর, কৈলাস দাসের মতো দেশবরেণ্য জাল নোট তৈরির কারিগর, দিনে ওস্তাদের মতো শ্রদ্ধেয় ছিনতাইশিল্পী এবং খুনে নবার মতো ডাকাবুকো খুনি কাজকারবার করেছেন। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এখানে নব-নব প্রতিভার বিকাশ ঘটেছে। তাঁরা আজ নেই বটে, কিন্তু রেখে গেছেন তাঁদের ঐতিহ্য। তবে আমরা সেই ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারিনি। বাংলার ভাগ্যাকাশে হঠাৎ দেখা দিয়েছিল দুর্যোগের ঘনঘটা। শশীবাবুর ভূতুড়ে হাত আমাদের সঙ্গে শত্রুতা শুরু করায় এই অঞ্চলের গৌরব রবি অস্তমিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আর ভয় নেই ভাইসব, ওই দ্যাখো প্রভাত-উদয়। চিরকাল তো অন্যায় আর অবিচার টিকে থাকতে পারে না। আসিছে নামিয়া ন্যায়ের দণ্ড রুদ্র দীপ্ত মূর্তিমান! শশীবাবু মৃত্যুশয্যায়। তাঁর ভুতুড়ে হাতও আজ নিস্পন্দ। এবার দিনবদলের পালা। আমাদের এখন দলাদলি, ব্যক্তিগত আক্রোশ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে কর্মযজ্ঞে, ঐতিহ্যকে আবার জাগিয়ে তুলতে হবে। উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত। কথাটার মানে আপনারা সবাই জানেন। এর মানে হল, ওঠো, জাগো, নিজের পাওনা-গণ্ডা আদায় করে নাও।”
সবাই চটপট হাততালি দিল। কেউ-কেউ কেয়াবাৎ’ বলে তারিফ করল। মিটিংটা বসেছে কালু সদারের শ্মশানকালী মন্দিরের চত্বরে, বটগাছের তলায়। সন্ধেবেলা, চারদিকে মশাল জ্বলছে। জনাপঞ্চাশেক কালো কালো চেহারার চোর-গুণ্ডা-বদমাশ-ডাকাত জড়ো হয়েছে। মিটিং থেকে একটু তফাতে একটা ঝোঁপের আড়ালে একজন বেঁটে আর একজন লম্বা লোক অলসভাবে বসে আছে। বেঁটে লোকটা বলল, “ফুঃ, এ লোকটার ঘটে বুদ্ধিসুদ্ধি নেই। বুঝলি ঝিকু, একে মন্ত্রী করা যাবে না।”
ঝিকু বলল, “তোমার তো কাউকেই পছন্দ হচ্ছে না দিনুদাদা। জটেশ্বর অত ভাল বক্তৃতা দিল, তাকেও মনে ধরল না। গৌরহরি কেমন বিচক্ষণের মতো কথাবাতা কইল, তাকেও বাতিল করে দিলে। তা হলে মন্ত্রীটা করবে কাকে?”
দিনু বলল, “এরা সব চুনোপুঁটি, বুঝলি? এদের কারও সত্যিকারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। উঁচু নজরের লোক না হলে সুবিধে হবে না কিনা।”
কাছাকাছি একটা মুশকো চেহারার লোক বসে ঢুলছিল। হঠাৎ সে তড়াক করে উঠে বলল, “কে হে তুমি, খুব চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে যাচ্ছ তখন থেকে? আমাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মতো বুকের পাটা পেলে কোথায়?”
দিনু হাতজোড় করে বলল, “মাপ করে দাও ভাই। ঠাট্টা করছিলুম।”
“ঠাট্টা! খুব রসিক লোক দেখছি। আলোতে মুখখানা একটু বাড়াও তো বাছাধন, বদনখানা একটু দেখে রাখি। তোমাকে একটু চিনে রাখা দরকার।”
মাটিতে পোঁতা একটা মশাল তুলে নোকটা ফস করে দিনুর মুখের সামনে ধরে বলল, “মুখখানা যে চেনা-চেনা ঠেকছে বাপ।”
দিনু খুবই বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আমি সামান্য মানুষ, পথেঘাটেই দেখে থাকবেন।”
“সামান্য মানুষ! তবে যে মন্ত্রী খুঁজছিলে? মন্ত্রী কাদের থাকে জানো? রাজাদের। তা তুমি কোথাকার ছদ্মবেশী রাজা, তা বড় জানতে ইচ্ছে করছে।”
দিনু অধোবদন হয়ে বলল, “আর লজ্জা দেবেন না ওস্তাদ। বছরতিনেক আগে পালঘাটে খুব মারধর খেয়েছিলুম পাবলিকের হাতে। মাথায় চোট হল, সেই থেকে কেমন খ্যাপাটে মেরে গেলুম। কেবল মনে হত, আমি হরিণগড়ের রাজা। আশ্চর্য কথা, হরিণগড় কোথায় তাও জানি না। যাই হোক, তিনটি বছর পাগলাগারদে থেকে এই হালে ছাড়া পেয়েছি।”
এদিকে যখন এসব কথাবার্তা হচ্ছে তখন মিটিংয়ে একটা স্লোগান উঠল, “শশীবাবুর সাদা হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। শশীবাবুর নোংরা হাত নিপাত যাক, নিপাত যাক।”
স্লোগানের মাঝখানেই হস্তশিল্পী গৌরহরি উঠে দাঁড়িয়ে অমায়িক মুখে বলল, “ভাইসব, আপনারা হক কথাই বলেছেন। শশীবাবুর অলক্ষুনে হাতটা ধরাধামে থাকলে আমাদের জীবনে শান্তি বলে কিছু থাকবে না। সুতরাং আমরা ঠিক করেছি, হাতটা তুলে এনে আমরা এই শ্মশানকালীর সামনে বলি দেব। তারপর টুকরো-টুকরো করে কেটে আগুনে আহুতি দিয়ে ফেলব। এই পবিত্র কাজে বেশি দেরি করা ঠিক হবে না। কথায় বলে শুভস্য শীঘ্রম। আগামীকাল কুঞ্জপুকুরে ভৈরব অপেরা যাত্রাগানের আসর বসাবে। গাঁয়ের লোক ঝেটিয়ে যাবে যাত্রাগান শুনতে। সেই ফাঁকে আপনাদের সহযোগিতায় এই অধম সামান্য হস্তশিল্পী ওই হাত শশীবাবুর বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলবে। কালই এখানে হাত বলি হবে। আপনাদের সকলের উপস্থিতি প্রার্থনীয়।”