বাড়ির কাছাকাছি হতেই তিনি চারদিকে লোকের ছোটাছুটি আর ব্যস্ততা লক্ষ করলেন। পুকুরের পাড়ে মেলা লোক, হ্যাঁজাক জ্বলছে। পুকুরে জাল ফেলা হচ্ছে। কে একজন দৌড়ে এসে বলল, “কবরেজমশাই, বাবলুকে পাওয়া যাচ্ছে না!”
নন্দ কবিরাজ বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। উত্তেজিত হলে চলবে না। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। রাত্রিবেলা বাড়ির লোক ডাকাডাকি করতে এলে তিনি বলে দিলেন যে, তাঁর শরীর-মন কোনওটাই ভাল নেই। কেউ যেন তাঁকে বিরক্ত না করে।
সারারাত কখনও বসে, কখনও পায়চারি করতে করতে অনেক ভাবলেন নন্দ কবিরাজ। দিনু বিশ্বেস তাঁকে খুবই ফাঁদে ফেলে দিয়েছে। একটি নিষ্পাপ শিশুর প্রাণরক্ষার জন্য তাঁকে হয়তো নীতিবোধ বিসর্জন দিতেই হবে। সারারাত ধরে তিনি বাড়ির মেয়েদের কান্নাকাটি, চেঁচামেচি শুনতে পেলেন। গাঁয়ের লোকরাও অনেকেই ঘুমোয়নি। বাবলুকে চারদিকে খোঁজা হচ্ছে। থানাতেও খবর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে যে বিশেষ লাভ হবে না, তা তাঁর চেয়ে ভাল আর কে জানে!
দারোগা সদাশিব রায় সকালেই এসে হাজির হলেন একটা জিপগাড়িতে চড়ে। মোটাসোটা আহ্লাদে মানুষ। পেটে তাঁর সাতরকমের ব্যায়ো। কবরেজমশাই বারোমাস তাঁকে ওষুধ গিলিয়ে কিছু করতে পারেননি। করা সম্ভবও নয়। কারণ সদাশিবকে খুশি রাখতে সকলেই তাঁকে প্রতিদিন নানারকম ভেট দিয়ে যায়। পুকুরের মাছ, গরুর দুধ, খাসির ঠ্যাং, ডিম, ক্ষীর, পায়েস, লাউ, কুমড়ো ইত্যাদি থরেথরে তাঁর বাড়িতে মজুত। সদাশিব খেতে বড্ড ভালবাসেন। নন্দ কবিরাজ প্রায়ই বলেন, “খাওয়াটা একটু না কমালে যে পাকস্থলী বিশ্রাম পাচ্ছে না সদাশিববাবু। পেটের সহ্যশক্তির তো একটা সীমা আছে।”
সদাশিব অত্যন্ত করুণ মুখ করে বলেন, “তার চেয়ে আমাকে আত্মহত্যা করতে বলুন কবরেজমশাই। তাতে কষ্টটা কম হবে। না-ই যদি খাব, তা হলে বেঁচে থেকে হবেটা কী? আপনি এমন ওষুধ বের করুন, যাতে আমার খাওয়া আর হজম দুটোই বজায় থাকে।”
তা সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
সদাশিব মোটা মানুষ। শীতকালেও তাঁর ঘাম হয়। সর্বদাই একটা হাঁসফাঁস ভাব। দুঃখ করে বলেন, “কী বলব, এই কুঞ্জপুকুর এলাকায় এসে অবধি চোর-গুণ্ডা বদমাশদের টিকিও নাগাল পাচ্ছি না। শশীবাবুর হাতই এখানে হাকিম। বলতে লজ্জা করে, হাতে কাজ না থাকায় আমি থানায় বসে সেপাইদের সঙ্গে লুডো খেলি।”
ভালমন্দ খেয়ে, লুডো খেলে আর আলসেমি করে সদাশিবের এখন করুণ অবস্থা। নড়তে-চড়তে অবধি কষ্ট। বারান্দায় পেতে রাখা চেয়ারে বসে, রুমালে কপালের ঘাম মুছে বললেন, “হাকিম সাহেব শয্যা নেওয়ার পর থেকে চারদিকে যেন বদমাইশির একেবারে হিড়িক পড়ে গিয়েছে।”
কবরেজমশাই অবাক হয়ে বললেন, “হাকিমসাহেব শয্যা নিয়েছেন নাকি? কই, আমি তো খবর পাইনি! এ তো অতি অন্যায় কথা, গত পাঁচ বছর যাবৎ আমি তাঁর চিকিৎসা করে আসছি, আর আমাকেই খবর দেওয়া হয়নি।”
সদাশিববাবু মাথা নেড়ে বললেন, “সে-হাকিম নয়। তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছায় ভালই আছেন। আমি আসল হাকিমের কথা বলছি। শশীবাবুর হাত। তিনি সেই যে শয্যা নিলেন, নট নড়ন চড়ন, আর ইদিকে বদমাইশরা কেমন চাঙ্গা হয়ে উঠেছে দেখুন। যেন ডবল ডোজে ভিটামিন খেয়ে নেমে পড়েছে। চতুর্দিকে চূড়ান্ত অরাজকতা। আর বলবেন না মশাই, এমন তাদের আম্পদ্দা যে, কাল নিশুত রাতে আমার শোওয়ার ঘরের জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে সে কী হিঃ হিঃ করে হাসি! শুধু হাসি? তারপর আবার গানও গাইল, মোটা দারোগা হবে রোগা।
চিন্তিত নন্দ কবিরাজ বললেন, “খুবই সাহস!”
“যা বলেছেন! ওই যে ভীম দাস বলে ডাকাতটা ছিল, সে তো ডাকাতি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ির গাঁয়ে গিয়ে দিব্যি চাষবাস করে গেরস্ত হয়ে গিয়েছিল। শুনছি, হাকিমসাহেব শয্যা নেওয়ার খবর পেয়ে সেও নাকি চাষবাস ছেড়ে মোটা দাঁও মারতে এদিকে এসে পড়েছে। হস্তশিল্পী গৌরহরি চুরি ছেড়ে শহরে গিয়ে পানের দোকান দিয়েছিল। সে নাকি পানের দোকান বেচে চলে এসেছে। খুনি জটেশ্বর পয়সা নিয়ে মানুষ খুন করে বেড়াত। হাকিমসাহেবের জন্য দেশছাড়া হয়েছিল। সেও ফের চারপাশে ঘুরঘুর করছে শুনতে পাই। নীলমণি ঘোষের সঙ্গে রামকমল পালের মামলা চলছে। তা জটা নাকি নীলমণিকে বলেছে, মামলা মোকদ্দমা করে বুড়িয়ে যাবেন কেন, পাঁচটি হাজার টাকা ফেলুন, রামকমলের লাশ নামিয়ে দিচ্ছি।”
“ও বাবা!”
“চারদিকে একেবারে পাপের তুফান উঠেছে মশাই। এসব সামাল দেওয়া কি একজন মাত্র দারোগার কাজ! চার-পাঁচজন দারোগা দরকার। আমি দু’বেলা মা কালীকে ডাকছি, শশীবাবু ভাল হয়ে উঠুন, হাকিমসাহেব গা-ঝাড়া দিয়ে কাজে নেমে পড়ুন, আমি জোড়া পাঁঠা দেব।”
নন্দ কবিরাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, “ঠিকই বলেছেন। চিরকাল দেখে আসছি, কুঞ্জপুকুর আর আশপাশের এলাকা হল গুণ্ডা বদমাশ তৈরির বীজতলা। এখান থেকেই যত চোর, ডাকাত আর খুনে তৈরি হয়। এখানকার আবহাওয়ায় বোধ হয় কিছু একটা আছে। শশীবাবুর হাত এসে সেই ভিমরুলের চাকে নাড়া দিয়েছিল। গুণ্ডা বদমাশরা প্রথমটায় গা-ঢাকা দিয়েছিল বটে, কিন্তু এখন সব জো পেয়ে প্রতিহিংসা নিতে দ্বিগুণ উৎসাহে ফিরে আসছে।”
সদাশিববাবু একটু ফ্যাকাসে হয়ে গিয়ে বললেন, “সেইজন্যই। তো আমি বদলি চেয়ে দরখাস্ত পাঠিয়ে দিয়েছি। এ-তল্লাটে। আমার অনেকদিন হয়ে গেল। আর নয় মশাই। আর আপনারাও বাবলুর জন্য মা কালীকে ডাকুন। যারা বাবলুকে চুরি করেছে, তারা হয়তো মুক্তিপণ চাইবে। চাইলে সেটা দিয়ে দেওয়াই ভাল। বুঝলেন?”