“যে আজ্ঞে। যথার্থই বলেছেন। প্রকৃতির নিয়ম বলে কথা! তারা বেরোলে পাপী-তাপীদের গতি কী হত বলুন! কবরেজমশাই, আপনার কি মনে হয় না, এ-জগতে পাপী-তাপীদের কিছু প্রয়োজন আছে? তাই যদি না থাকবে, তা হলে কি ভগবান পাপী-তাপী সৃষ্টি করতেন? বলুন না, আপনি বিজ্ঞ লোক। কদিন ধরে খুব ভাবছি, পাপী-তাপীদের বিনাশটা ভগবানও যেন ভাল চোখে দেখেন না, নইলে এতকাল ধরে তারা টিকে থাকত না। শশীবাবুর ওই বিটকেল হাতটার কথাই ধরুন! কত গুণ্ডা বদমাশকে মেরে পাট-পাট করল, কত পাপী-তাপীর বারোটা বাজাল, তবু নিকেশ করতে পারল কি? পাপী-তাপী তো নিকেশ হলই না, উপরন্তু নিজেই এখন নেতিয়ে পড়ে আছে।”
“অত ভরসা কোরো না হে। হাতটা আবার একদিন তেড়ে-ফুঁড়ে উঠবে।”
লোকটি অতি বিনয়ের সঙ্গে বলল, “উঠবে বলছেন? তা হলে তো ভয়ের কথাই হল মশাই। হেঃ হেঃ, তা যেমন বুনো ওল আছে, তেমনই বাঘা তেঁতুলও আছে। ভগবান সব বন্দোবস্তই করে রেখেছেন কি না। এক তরফা কিছু হতে দেন না। সবসময়ে হাতে দাঁড়িপাল্লা ধরা আছে। পাপ বাড়লে পুণ্যিও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। পুণ্যি কমলে পাপও কমাচ্ছেন। কোনওদিকে পাল্লা বেশি ঝুঁকতে দেন না। ভ ভদ্রলোক আর যাই বলুন, একচোখো নন।”
“আর সময় নষ্ট কোরো না হে। যা বলার, বলে ফেলো।”
“যে আজ্ঞে! ঘুরেফিরে বলছি। আপনার মতো জ্ঞানী লোকের দেখা তো আমাদের বরাতে সহজে জোটে না। দু দণ্ড দাঁড়িয়ে এই যে কথা বলছি, এতেও আমার কত শিক্ষা হয়ে যাচ্ছে।”
“তোমার হচ্ছে কিনা জানি না, তবে আমার হচ্ছে।”
লোকটি লজ্জার সঙ্গে বলল, “কী যে বলেন কবরেজমশাই! তবে কিনা হক কথাই বলেছেন। আমিও ভাবি, পাপী-তাপী বা পাজি-দুদের কাছে পণ্ডিতদেরও কি কিছু শেখার নেই? ঢের আছে মশাই, ঢের আছে।”
“দিন বিশ্বেস, কথাটা কী?”
“আজ্ঞে ছোট্ট কথা। বললেই ফুরিয়ে যাবে। শুনলে আপনি হয়তো ভাববেন, এই সামান্য কথাটা দিনু ফস করে বলে ফেলতে পারল না? তবে মশাই, সব কথা ফস করে বলাটা ভালও নয়। জমি তৈরি না হলে কি তাতে বীজ ফেলা ভাল? আপনার বয়স, ব্লাড প্রেশার, হার্টের অবস্থা সব খেয়াল রেখে হুঁশিয়ার হয়ে বলতে হবে তো? কথাটা শুনেই আপনি হয়তো ভিরমি খেলেন, তখন তো আমার একগাল মাছি।”
“তা বটে। তুমি সত্যিই বিবেচক লোক।”
“যে আজ্ঞে! মুখ বটি, তবে অবিবেচক নই। ধরুন, আমি একজন দোকানদার, আমার চাই পয়সা, আর আপনার চাই জিনিস। ঠিক তো?”
“ঠিক।”
“এও সেই বৃত্তান্ত। আপনার চাই নাতি, আর আমাদের চাই হাতি।”
“হাতি?”
“ওই হল। মিল দেওয়ার জন্য বলেছি। আপনার চাই নাতি আর আমাদের চাই হাতটি। বুঝলেন?”
“না।”
লোকটি বিস্মিত হয়ে বলে, “এমন পাকা মাথায় কথাটা ঢেউ খেলছে না কেন, বলুন তো! এ তো জলবৎ তরলং ব্যাপার। শশীবাবুর ওই অলক্ষুনে হাতটি আমাদের হস্তগত করে দিলেই আমাদের হাত থেকে আপনার নাত ছাড়া পেয়ে যাবে।”
“নাত?”
“ওই হল। মিল দেওয়ার জন্য বলা। আপনার নাতি।”
নন্দ কবরেজ একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, “এবার বুঝেছি।”
“হেঃ হেঃ। জলের মতো সোজা। তবু বলি, তাড়াহুড়ো করে বোঝবার দরকার নেই। বরং একটু তলিয়েই বুঝুন। অনেক সময়ে বুঝটা তেমন পাকা হয় না। তখনই নানা ফাঁকড়া বেরোয়। দরকার হলে আরও ভাল করে বুঝিয়ে দিচ্ছি।”
নন্দ কবরেজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বোঝও বাপু।”
“শশীবাবুর বাড়ি যেভাবে পাহারা দেওয়া হচ্ছে, তাতে ওই হাতের নাগাল পাওয়া আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই বলছিলুম, আপনি তাঁর চিকিৎসা করছেন, অবারিত দ্বার, এই ছোট কাজটা যদি নাতির স্বার্থে করে দেন, তা হলে বড় উপকার হয় আমাদের।”
“হাতটা চুরি করতে বলছ?”
“চুরি! ছি ছি, চুরির কথা ওঠে কেন? হস্তান্তর বলে একটা যেন ভাল কথা আছে। বেশ ভদ্র, সভ্য কথা। আপনি যদি হাতটাকে হস্তান্তর করে দেন, তা হলে সব দিক বজায় থাকে।”
লাঠিটা ফের শক্ত করে চেপে ধরলেন নন্দবাবু। ইচ্ছে হল, লোকটাকে আচ্ছাসে ঘাতক দেন। কিন্তু তাতে লাভ তো হবেই না, উপরন্তু বাবলুর ক্ষতি হয়ে যাবে। তিনি অসহায় গলায় বললেন, “এ কাজ আমার দ্বারা হওয়ার নয় বাপু! আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।”
“ওইসব শব্দ যে কোন আহাম্মক তৈরি করেছিল! বিশ্বাসঘাতকতা কথাটাকে ডিকশনারি থেকে লোপাট করে দেওয়া। উচিত। আমি বলি কি কবরেজমশাই, আজ রাতটা বেশ ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন। আমাদের তাড়া নেই। বেশ ভাল করে ভাবুন, যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে। আর ওইসব ভাল-ভাল কথাগুলোকে মোটেই আমল দেবেন না মশাই। আপদ্ধর্ম বলে একটা কথা আছে। বিপদ-আপদ এলে তখন অনেক নীতিবাক্য লঙ্ঘন করাটাই ধর্ম। প্রাণ আগে, না নীতি আগে! যান, এখন বাড়ি যান। ওদিক থেকে লোকজনের সাড়া পাচ্ছি। শুধু একটা কথা মনে রাখবেন, এই যে আমার সঙ্গে আপনার দেখাঁটি হয়ে গেল, একথা দয়া করে ফাঁস করবেন না। তাতে আপনার নাতির ভাল হবে না। দেখাটা যে হয়েছিল, সেটা একদম বেমালুম ভুলে যান। আমি কাল আবার সন্ধের পর আসব।”
“কোথায় দেখা হবে?”
“সে নিয়ে আপনি ভাববেন না। সুবিধেমতো একটা জায়গায় ঠিক হাজির হয়ে যাব। যখন একাবোকা থাকবেন, তখন দেখবেন অধম আপনার শ্রীচরণ দর্শনে হাজির।”
বলেই লোকটা অন্ধকারে ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেল।
চিন্তিত কবিরাজমশাই নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। মনটা বড়ই বিষণ্ণ। নানা আশঙ্কায় বুকটা দুরুদুরু করছে। বাবলুকে তিনি প্রাণাধিক ভালবাসেন। বাবলুও সারাদিন দাদুর ছায়া হয়ে ঘোরে। তাকে কোথায় নিয়ে গেল, কী অবস্থায় রেখেছে, মারধর করছে কিনা কে জানে! বেঁচে আছে তো! ভাবতে-ভাবতে নন্দ কবিরাজের দু চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়তে লাগল।