লোকটার মুখে ‘শনৈঃ শনৈঃ শুনে নন্দ কবিরাজ একটু ভ্রূকুটি করলেন। বললেন, “ঠিক আছে। যা বলার আছে, বলো।”
“বলছিলাম কি, শশীবাবুর আয়ু ফুরিয়েছে। শরীরটাও জরাজীর্ণ। আপনি আর দয়া করে তাঁর চিকিৎসা করবেন না। গাছগাছড়া আনতে চারদিকে লোক গেছে শুনলাম। তা সেগুলো তাঁরা আনুন। আপনার আর সেগুলো কাজে লাগিয়ে দরকার নেই।”
“তার মানে?”
“মানে খুব সোজা। শশীবাবুর গঙ্গাযাত্রায় আর বিলম্ব ঘটিয়ে পাপের বোঝা ভারী করবেন কেন?”
“তুমি কি শশীবাবুর মৃত্যু চাও?”
“ছি ছি। কী যে বলেন! গীতায় সেই যে শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, মনে নেই? যা ঘটার তা ঘটেই আছে, তুমি নিমিত্ত মাত্র হও সব্যসাচী! এ হল প্রায় সেই বৃত্তান্ত। শরীরের খাঁচাটা পুরনো হলে তো বদলাতেই হয়, না কি? আপনি এত বড় কবরেজ, জীবন-মৃত্যু নিয়ে কারবার, এ কি আপনার জানা নেই?”
নন্দ কবিরাজ কুপিত এবং বিস্মিত হয়ে বললেন, “তোমার মতলব তো ভাল ঠেকছে না বাপু! তুমি তো দেখছি, মানুষ খুন করতে পারো।”
লোকটি খুবই শান্ত ও অমায়িক গলায় বলল, “তাই যদি হবে, তা হলে শশীবাবুকে তো কবেই খুন করে ফেলতে পারতাম। নির্জীব হয়ে পড়ে আছেন, ও-মানুষকে খুন করা শক্ত কী?”
“তা হলে চিকিৎসা বন্ধ করতে বলছ কেন?”
লোকটা যেন খুবই সঙ্কোচের সঙ্গে বলল, “খুনের কথাটা তুলে আপনি বড় গণ্ডগোলে ফেলে দিলেন। ওসব কথা ভাবাও পাপ। খুনের কথা হচ্ছে না, বলছি, বয়সের নিয়মে উনি যদি মারাই যান, তা হলে তাতে বাধা হওয়া উচিত নয়। একশো সাত বছর বেঁচে আছেন, আর কিসের দরকার বলুন তো?”
“তোমাকে বাপু, পুলিশে দেওয়া উচিত। শশী গাঙ্গুলি মারা গেলে কী হবে জানো? তোমার মতো পাজি লোকেদের আস্তানা হবে এই কুঞ্জপুকুর।”
লোকটা খ্যাচ করে একটু হেসে বলল, “চোখ বটে আপনার! এই অন্ধকারেও আমাকে পাজি বলে ঠিক চিনেছেন কিন্তু।”
“তোমার মতো লোককে চিনতে দেরি হয় না। শোনো বাপু, শশী গাঙ্গুলির শত্ত্বরের অভাব নেই। একটা জীবন বিস্তর চোর-ডাকাত, গুণ্ডা বদমাশকে ঢিট করেছেন। তারা যে শশী গাঙ্গুলির মৃত্যু চায়, তাও আমরা জানি। আর তাই শশীখুড়োর বাড়ির চারধারে গাঁয়ের লোক শক্ত পাহারা বসিয়েছে। গাঁয়েও দল বেঁধে টহল দিচ্ছে। কাজেই তোমাকে বলি, সরে পড়ো। সুবিধে হবে না।”
লোকটা একটুও চটল না। পরম বিনয়ের সঙ্গে বলল, “যে আজ্ঞে! আমি হেরেই গিয়েছি বলে ধরে নিন। তবে কিনা, আর একটা ছোট মাপের কথা ছিল। সেইটে বলেই আমি নাহয় সরে পড়ব। অভয় দেন তো বলি?”
“তোমার আম্পদ্দা দেখে অবাক হচ্ছি। তবু বলেই ফেলো।”
“আপনার একটা ফুটফুটে নাতি আছে। তার নাম বাবলু। বছর পাঁচেক বয়স হবে। ঠিক বলছি?”
নন্দ কবিরাজ একটু শক্ত হয়ে গেলেন। বললেন, “হাঁ, কিন্তু কী চাও?”
লোকটি খুবই দুঃখের গলায় বলল, “বেলতলার মাঠে আজ বিকেলেও খেলছিল অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে, কিন্তু সন্ধের পরও সে আজ বাড়ি ফেরেনি।”
“অ্যাাঁ!” বলে নন্দ কবিরাজ চমকে উঠলেন।
লোকটা শশব্যস্তে বলল, “আহা, ব্যস্ত হবেন না। তাকে খুঁজতে চারদিকে লোক গেছে। এই পথেই একটু আগে খুঁজে গেছে তারা। বাড়ির আর আশপাশের পুকরে জাল ফেলা হচ্ছে। একটু এগোলেই শোরগোল শুনতে পাবেন।”
“সর্বনাশ!” বলে নন্দ কবিরাজ ঘুরে দু পা এগিয়েই দাঁড়িয়ে পড়লেন।
লোকটা পেছন থেকে বলল, “বলেছি তো ব্যস্ত হবেন না। ব্যস্ত হয়ে লাভ নেই। বাবলুকে পুকুরে বা আর কোথাও পাওয়া যাবে না।”
নন্দ কবিরাজ কাঁপতে কাঁপতে হাতের মোটা বাঁশের লাঠিটা তুলতে যাচ্ছিলেন। লোকটা একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল, “কাজটা কাঁচা হয়ে যাচ্ছে না কবরেজমশাই?”
“তুই! তুই আমার নাতিকে চুরি করেছিস?”
“চুরি! চুরির কথা উঠছে কিসে? ধরে নিন না কেন, তাকে একরকম পুষ্যিই নিয়েছি। ঘাবড়াবেন না, সে এখন আমাদের ডেরায় দিব্যি ভাত খাচ্ছে। তারপর ঘুমোবে। খেলনা-টেলনাও দেওয়া হয়েছে। নাতি কিছু খারাপ নেই।”
“কী চাস?”
“এইবার বিবেচকের মতো কথা বলেছেন। পাকা মাথা দিব্যি কাজ করছে। খামোক লাঠি চালিয়ে একটা কেলেঙ্কারি করতে যাচ্ছিলেন। বুদ্ধিমান মানুষ সব সময়েই পরিস্থিতি বুঝে সেইমতো চলে। লাঠিখানা দিয়ে আমার মাথা যদি ভাঙতেন, তা হলে আমার তুচ্ছ প্রাণটাই তো শুধু যেত না, আপনার আদরের নাতিটারও আর হদিস পেতেন না।”
নন্দ কবিরাজ বাঘা গলায় গর্জন করে বললেন, “বাজে কথা ছাড়ো। কাজের কথায় এসো।”
“তুই-তোকারি করছিলেন, তা, সেটাও চালিয়ে যেতে পারেন। বড়ই তুচ্ছ মানুষ আমরা। না, না, আর বেশি রেগে যাবেন না। আপনার বয়স পঁচাত্তর, এই বয়সে রাগটাগ ভাল নয়। অভয় দিলে এবার তা হলে কাজের কথায় আসি?”
নন্দ কবিরাজ রাগ-দুঃখ-ভয়ে কথা বলতে পারলেন না।
লোকটা খুবই বিনম্র গলায় বলল, “কাজের কথাটা খুবই সরল। যাকে বলে, ফেলো কড়ি মাখো তেল। কিংবা শঠে শাঠ্যং। কিংবা, কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ! না, না, এই শেষেরটা ঠিক লাগসই হল না।”
নন্দ কবিরাজ ফের গর্জন করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কাহিল গলা দিয়ে একটা ফ্যাঁসফ্যাসে স্বর বেরোল, “কাজের কথাটা বলবে?”
“যে আজ্ঞে, কথাটা বলব বলেই তো ঘাপটি মেরে ছিলুম এতক্ষণ। সাপখোপের ভয়ে আধমরা হয়ে। তা ইদিকে কি শীতে সাপ বেরোয় কবরেজমশাই।”
“বেরোলে তো ভালই ছিল হে! কেন যে বেরোয় না, কে জানে!”