ভীম দাস নাকে খত দিল, কবুলও করল।
“এবার দু’ঘড়া মোহর নিয়ে এসো।”
ভীম দাসের শাগরেদরা তক্ষুনি গিয়ে মোহর নিয়ে এল। শশী গাঙ্গুলি খুশি হয়ে বললেন, “দুঘড়া মোহরে অনেক কাজ হবে। গাঁয়ের রাস্তাঘাট মেরামত, পুকুর সংস্কার, গরিব মেয়েদের বিয়ে, গরিব ছেলেদের লেখাপড়া শেখা, আরও কত কী! ওহে ভীম দাস, যাও, হাতখানা তুমিই নিয়ে যাও।”
ভীম দাস মহা উল্লাস করতে করতে ফিরে গেল হাতখানা নিয়ে। দু’দিন বাদে এক সকালে হাতখানা নিয়ে শশী গাঙ্গুলির পায়ে এসে আছড়ে পড়ে বলল, “হাত ফেরত নিন ওস্তাদজি, গত দু’দিন আমাকে দিনে রাতে তিষ্টোতে দেয়নি। খেতে বসেছি, অমনই হতচ্ছাড়া এসে এমন কাতুকুতু দিল যে, খাওয়া মাথায় উঠল! ঘুমোতে গেলেই মাথায় এসে তবলা বাজায়। শাগরেদদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করছি, কথা নেই বাত নেই হঠাৎ এসে গলা টিপে ধরল। গতকাল ডাকাতি করতে বেরোতে যাচ্ছি ব্যাটাকে সঙ্গে নিয়ে, এই দেখুন গালে এমন চিমটি দিয়েছে যে, কালশিটে পড়ে গেছে। এ-বেয়াদব হাত আমার চাই না। আমার দলও ভেঙে যাচ্ছে। বিয়েবাড়ির ঘটনার পর থেকে আমাকে আর কেউ মানছেও না। আমি আমার মামাশ্বশুরের গাঁ মনসাপোঁতায় চলে যাচ্ছি। চাষবাস করেই বাকি জীবন খাব।”
তা শশীদাদুর সঙ্গে-সঙ্গে সেই হাতখানাও ঝিমিয়ে পড়ায় তল্লাটে মহা দুশ্চিন্তা।
২. নন্দ কবিরাজ খুবই চিন্তিত
নন্দ কবিরাজ খুবই চিন্তিত, শশী গাঙ্গুলির অবস্থাটা তিনি ভাল বুঝতে পারছেন না। রোগলক্ষণ তেমন কিছু নেই। বার্ধক্যজনিত দুর্বলতাতেই ঝিমিয়ে পড়ছেন বলে মনে হচ্ছে তাঁর। অনেকরকম পাঁচন করে খাইয়ে ফল পাচ্ছেন না তেমন। একটা পুরনো দুষ্প্রাপ্য বইয়ে গতকালই একটা ভেষজ ওষুধের কথা পেয়েছেন। ত্রিশ রকমের গাছগাছড়া আর মূল লাগবে। সেইসব ভেষজ জোগাড় করা চাট্টিখানি কথা নয়! গাঁয়ে মাতব্বরদের বলেছেনও সে-কথা। তারা বিভিন্ন জায়গায় লোক পাঠাচ্ছেন সেইসব জিনিস সংগ্রহ করতে।
শশী গাঙ্গুলির নাড়ির গতি খুব ক্ষীণ। দুর্বলতা এতই বেশি যে, চোখের পাতা মেলতে পারেন না। ডাকলে সাড়া দেন না। সন্ধেবেলা শশী গাঙ্গুলিকে দেখে নন্দ কবিরাজ খুব অন্যমনস্কভাবে বাড়ি ফিরছিলেন। ভেষজগুলো যদি ঠিকমতো পাওয়া যায় তা হলে ওষুধটা তৈরি করতে দিন সাতেক সময় লাগবে। এই দিন সাতেক রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় চিন্তা করছিলেন তিনি। নানারকম নিদানের চিন্তা মাথায় ঘুরছে।
ডাইনি-পুকুরের কাছে বাবলাগাছের জঙ্গল। জায়গাটা ভারি নির্জন আর অন্ধকার। চারদিকে শুধু জোনাকি পোকা জ্বলছে। বহু পুরনো একটা জামগাছ ডালপালা মেলে আকাশটা একরকম ঢেকেই ফেলেছে। সন্ধের পর এ রাস্তায় লোক-চলাচল নেই। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বেশ অমায়িক গলায় বলে উঠল, “কবরেজমশাই নাকি?”
গলাটা অচেনা। নন্দ কবিরাজ ফিরে তাকিয়ে বেঁটেমতো একটা ছায়ামূর্তিকে দেখতে পেয়ে বললেন, “কে আপনি?”
“আমাকে চিনবেন না। অধমের নাম দিনু বিশ্বেস। শশীবাবুকে দেখে এলেন বুঝি? তা অবস্থা কেমন?”
শতবার এই প্রশ্নের জবাব দিতে-দিতে নন্দ কবিরাজ একটু বিরক্ত, বললেন, “ওই একই রকম। ভালও নয়, খারাপও নয়।”
“পাল্লাটা কোনদিকে ভারী? ভালর দিকে, না খারাপের দিকে?”
“বলা কঠিন।” বলে কবিরাজমশাই মুখ ফিরিয়ে হাঁটা ধরলেন।
লোকটি পিছু-পিছু আসতে-আসতে বলল, “কবরেজমশাইয়ের কি তাড়া আছে নাকি?”
নন্দ কবিরাজ এবার একটু চটে উঠে বললেন, “তা দিয়ে তোমার কী দরকার হে?”
খুবই অমায়িক গলায় লোকটা বলল, “শুনতে পাচ্ছি, আপনি নাকি নতুন একটা ওষুধের সন্ধান পেয়েছেন। সেটা নাকি মৃতসঞ্জীবনী। এক ঢোক খেলেই মরা মানুষও উঠে বসে! তাই বলছিলুম, কাজটা কি ঠিক হবে কবরেজমশাই? শশীবাবুর আয়ু প্রকৃতির নিয়মেই ফুরিয়েছে। তাকে জোর করে বাঁচিয়ে রাখলে কি খোদার ওপর খোদকারি হবে না?”
নন্দ কবিরাজ খাপ্পা হয়ে বললেন, “আচ্ছা বেয়াদব লোক তো তুমি? আমাকে নীতিকথা শেখাচ্ছ?”
“আজ্ঞে না। নীতিকথা আপনারও কিছু কম জানা নেই। তবে হয়তো সবসময়ে খেয়াল রাখতে পারেন না। তাই একটু স্মরণ করিয়ে দেওয়া আর কি?”
“স্মরণ আর করাতে হবে না। আমার স্মৃতিশক্তি যথেষ্ট আছে। এবার বাপু, তুমি নিজের কাজে যাও।”
লোকটা খ্যাক করে একটু হেসে বলল, “আজ্ঞে, নিজের কাজেই আসা। আপনার হাতে যদি সময় থাকে, তবে দুটো কথা বলতুম।”
“না, আমার সময় নেই। তুমি এসো গিয়ে।”
“শুনতে না চাইলে শুনবেন না, কান দুটো তো আপনার। না শোনার হক তো আছেই। তবে কিনা কথাটা খুব মন্দ ছিল না।”
নন্দ কবিরাজ মনে-মনে চটে গেলেও নিজেকে সংযত করে বললেন, “সংক্ষেপে বলতে পারলে বলে ফেলো। হাঁটতে-হাঁটতেই বলো।”
“আজ্ঞে, তা হবে না। ডাইনি-পুকুরের ওধারে আমার পক্ষে যাওয়ার অসুবিধে আছে। দয়া করে এখানেই একটু দাঁড়িয়ে যান। নিরালা আছে, অন্ধকারও আছে। কথাটা পাঁচকানও হবে না, আর আমার পোড়া মুখখানাও আপনাকে দেখতে হবে না।”
লোকটার কথার ধরন-ধারণ মোটেই ভাল ঠেকল না নন্দ কবিরাজের কাছে। কিন্তু তিনি মাথা গরম করলেন না। বললেন, “এমন কী কথা বাপু যে, নির্জনে বলতে হবে? তুমি কোথা থেকে আসছ? মতলবটাই বা কী?”
“অত কথা খোলসা করে বলতে কিছু অসুবিধে আছে কবরেজমশাই। শনৈঃ শনৈঃ জানতে পারবেন অবশ্য।”