ভৈরবী নদীতে সেবার বর্ষাকালে নৌকোডুবিতে অন্তত ষাট-সত্তরজন তলিয়ে গিয়েছিল। সেই ভীষণ স্রোতে কারও বাঁচার আশা ছিল না। শশীদাদুর হাত টপাটপ জলে ডুবে এক-একজন ডুবন্ত মানুষকে চুলের মুঠি ধরে তুলে এনে তীরে ফেলতে লাগল। একটা মানুষকেও মরতে দেয়নি।
তবে হাতের সবচেয়ে বড় অবদান হল কুঞ্জপুকুরের পুব দিকে শ্মশানঘাটের কাছে পঞ্চবটীর কুখ্যাত ডাকাত সর্দার ভীম দাসকে ঢিট করা। ভীম দাস ছিল এলাকার ত্রাস। ডাকাতি করার জন্য তার রাতের অন্ধকার দরকার হত না। দিনমানেই গিয়ে যে-কোনও বাড়িতে লুটপাট করে আসত। দারোগা-পুলিশও তাকে যমের মতো ভয় খেত।
সারা পৃথিবী ঘুরে যেবার শশীদাদু গাঁয়ে ফিরলেন, সেবারকার ঘটনা। গাঁয়ের পরেশ পাল গরিব মানুষ। মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। পরেশবাবু অতি কষ্টে ধার-দেনা করে মেয়ের জন্য গয়না গড়িয়েছেন। সেই গয়নায় সাজিয়ে মেয়েকে বিয়ের আসরে নিয়ে এসেছেন। এমন সময়ে ভীম দাস দলবল নিয়ে রে-রে করে হাজির। ডাকাতদের হাতে সড়কি, বল্লম, টাঙি, খাঁড়া, বন্দুক দেখে নিমন্ত্রিতরা পালিয়ে গেল। বরযাত্রীরা গিয়ে ঝাঁপ খেল পুকুরে। বরকতা সুপুরিগাছে উঠে পড়লেন। বরও পালানোর চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু গাটছড়া বাঁধা থাকায় পারেনি। ভীম দাস কনের গা থেকে গয়না খুলে নিল, বরকে দিয়ে পা টেপাল, তারপর দলবল নিয়ে নেমন্তন্নবাড়ির সব আনন্দ মাটি করে দিয়ে রওনা
দিল। ঠিক সেই সময়ে শশী গাঙ্গুলি এসে তার পথ আটকে দাঁড়ালেন। বললেন, “কেমনধারা লোক মশাই আপনি? একটা মেয়ের বিয়ে পণ্ড করে দিলেন? এমন একটা শুভ কাজে বিঘ্ন ঘটানো কি মানুষের কাজ?”
লোকটার স্পর্ধা দেখে ভীম দাস এমন অবাক হল, কিছুক্ষণ বাক্য বেরোল না। তারপর একটা হুঙ্কার দিয়ে সে বলল, “কার সঙ্গে কথা বলছিল, জানিস?”
শশী গাঙ্গুলি একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে বললেন, “জানি। আপনি একটা ছুঁচো, ডাকাতদের মধ্যেও অনেক সহবত জানা ডাকাত আছে, তারা অনেকে দান-ধ্যানও করে। কিন্তু আপনি একটি নোংরা লোক। ভাল চান তো গয়নাগাটি, বাসনকোসন সব ফিরিয়ে দিন। নইলে ভাল হবে না।”
এই কথা শুনে ভীম দাসের সে কী অট্টহাসি! হাসির দমকে ঝাড়বাতি অবধি দুলতে লাগল, কুকুরেরা কেঁউ-কেঁউ করতে করতে পাড়া ছেড়ে পালাল।
হাসি থামার পর ভীম দাস মোলায়েম গলায় বললে, “ফিরিয়ে দিলে কী করবি? মারবি নাকি রে? অ্যাাঁ। মারবি? তা মারবি যে, হাতে তো একটা লাঠিও নেই দেখছি। আর ওই রোগাপটকা হাত দিয়ে যদি মারিসও, তা হলে যে তোর হাতটাই জখম হবে। আমার এই শরীর এত শক্ত যে, বল্লম অবধি গাঁথতে চায় না। আয় না, কাছে আয়, একটু ধরেই দেখ না আমার হাতখানা, আমার গা টিপে দ্যাখ।”
শশী গাঙ্গুলি ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে বললেন, “তোমার মতো পাপীকে ছুঁলে চান করতে হবে। এই শীতের রাতে আমি তা পেরে উঠব না বাপু। যা বলছি ভালয়-ভালয় করো, গয়নাগাটি যার যা নিয়েছ সব ফিরিয়ে দাও, তারপর নাকে খত দিয়ে বাড়ি যাও। আর ডাকাতি-টাকাতি কোরো না, কথা না শুনলে মুশকিল আছে।”
ভীম দাসের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। হাতের তলোয়ারখানা তুলে তবে রে’ বলে বনবন করে কয়েক পাক ঘুরিয়ে সে শশী গাঙ্গুলির ওপর লাফিয়ে পড়ল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, লাফ মেরে সে সেই যে শূন্যে উঠল, আর নামল না। দেখা গেল ভীম দাস ধীরে ধীরে ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে তো উঠেই যাচ্ছে। ভীম দাসের চোখ ছানাবড়া, হাত-পা ছুঁড়ছে আর চেঁচাচ্ছে “ওরে তোরা আমাকে নামা, নামা। এসব কী হচ্ছে! পড়ে যাব যে। আমার ঘাড়টা এমন সাপটে ধরেছে কে বল তো?” ঘাড়ে যে হাতখানা চেপে বসেছে, তাকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করল ভীম দাস। পারল না। প্রায় তিনতলা সমান উঁচুতে তুলে তারপর খানিক দূর নিয়ে গিয়ে হাতটা দুম করে ছেড়ে দিল তাকে। আর ভীম দাস তার পর্বতপ্রমাণ শরীরটা নিয়ে গদাম করে পড়ল পুকুরে। ফলে পুকুরে সমুদ্রের মতো ঢেউ উঠল। এই দৃশ্য দেখে ডাকাতরা চো-চাঁ দৌড়তে শুরু করল। কিন্তু পারল না।
দুমদাম ঘুসি খেয়ে সব ছিটকে ছিটকে পড়তে লাগল। মাত্র কয়েক মিনিটেই কাজ শেষ।
এর পর ঘাবড়ে-যাওয়া ডাকাতরা শশী গাঙ্গুলির হুকুমে বরযাত্রীদের খাওয়ার সময় পেছনে দাঁড়িয়ে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করল, এঁটো পরিষ্কার করল, কুয়ো থেকে জল তুলে আনল। স্বয়ং ভীম দাস আর তার পয়লা নম্বর শাগরেদ বটু কীর্তনিয়া বরকতা আর কন্যাকতার পা টিপল বসে বসে। শেষমেশ বিয়েবাড়ির নেমন্তন্নও তারা খেল। যাওয়ার সময় ভীম দাস বিনয়ে বিগলিত হয়ে হাত কচলাতে কচলাতে শশীদাদুকে বলল, “জিনিসটা বড়ই সরেস ওস্তাদজি, আমার দু’ঘড়া খাঁটি মোহর আছে, যদি জিনিসটা দেন তো দু’ঘড়া মোহরই আপনাকে প্রণামী পাঠিয়ে দেবখন। এরকম একখানা জিনিস থাকলে আমার কাজকারবারে বড় সুবিধে হয়। রোজ-রোজ ঝুটমুট লোকজনের ওপর হামলা-হুঁজ্জত করতে আমারও আর ভাল লাগছে না। হাতখানা পেলে তাকে দিয়েই সব কাজকারবার করাব, আর আমি বসে বসে টাকা আর মোহর গুনব।”
শশী গাঙ্গুলি একটু হেসে বললেন, “এ তো খুব ভাল প্রস্তাব। আগে নাকে খতটা দাও, তারপর হাতজোড় করে সকলের কাছে। কবুল করো যে, আর জীবনে ডাকাতি করবে না, তারপর কথা হবে।”