কাণ্ড দেখে সবাই হতবাক! পেছনে মানুষজন হর্ষধ্বনি করে উঠল।
হঠাৎ কবরেজমশাই সোজা গিয়ে চন্দ্ৰমাধবের পায়ের ওপর পড়ে বললেন, “চিনতে পেরেছি শশীখুড়ো। এ আপনি ছাড়া, আর কেউ নন!” বলে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
চন্দ্ৰমাধব তাঁর নকল দাড়ি-গোঁফ আর চুল খুলে ফেলতেই চারদিকে তুমুল চিৎকার উঠল, “শশীদাদু, শশীজ্যাঠা, শশীখুড়ো, শশীভায়া যে!”
শশীবাবু নন্দ কব্রিাজকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “কোনও অপরাধ করোনি ভাই। তোমার অবস্থায় পড়লে যে-কোনও মানুষই এমনটি করত। বাবলুর জন্য চিন্তা কোরো
। আমার হাত গিয়ে আজ সকালেই তাকে উদ্ধার করে এনে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। বাড়ি গিয়েই তাকে দেখতে পাবে।”
“কিন্তু শশীখুড়ো, হাতটা যে দিনু বিশ্বেসের হয়ে গিয়েছিল?” শশীবাবু স্মিতহাস্যে বললেন, “কোনওদিনই হয়নি। দিনু মন্ত্র জানত না। যে মন্ত্র বলেছিল, তাও ভুল। হাতটাকে আমিই বলেছিলাম ওর কথামতো চলতে।”
“কেন শশীখুড়ো?”
“তোমাদের এলেম পরীক্ষা করতে। আমার হাতের ওপর নির্ভর করতে করতে তোমাদের আত্মশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। কমে যাচ্ছিল নিজেদের ওপর নির্ভরতা। তাই অসুখের ভান করতাম।”
লোকজন ঘিরে ধরেছে শশীবাবুকে। একজন বলল, “কিন্তু আপনি যে মারা গেলেন?”
শশীবাবু হেসে বললেন, “ও তো সাজানো ব্যাপার।”
কবরেজ বললেন, “আর তান্ত্রিক। সেও কি সাজানো? আপনার যে নাড়ি বন্ধ ছিল, শ্বাস চলছিল না?”
শশীবাবু স্মিতহাস্যে বললেন, “তান্ত্রিক তো নয়াগঞ্জের জগা। যাত্রার দলে ভাল পার্ট করে। আর নাড়ি যে-কেউ কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে দিতে পারে। সহজ প্রক্রিয়া আছে। আর শ্বাস? তুমি যখন আমার নাকের কাছে হাত দিলে, শুধু তখন আমি দমটা বন্ধ করে দিলাম।”
“কিন্তু এসব করলেন কেন? দিনু যে এত কাণ্ড করল!”
লে তোমরা প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারো কি না! তাই হাতটাকেও তোমাদের বিরুদ্ধেই প্রয়োগ করলাম। দেখলাম, নাঃ, তোমরা ততটা অপদার্থ হয়ে যাওনি সবাই। বেশির ভাগ যদিও দিনুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, তবু কয়েকজন যে রুখে দাঁড়িয়েছিল তাইতেই আমি খুশি। সমাজে সত্যিকারের সাহসী কয়েকজনই থাকে। তারা যদি গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে, তবে বাদবাকিরা তাদেরই অনুসরণ করে।”
“তা হলে এখন থেকে হাতটা আগের মতোই কাজ করবে তো?”
শশী গাঙ্গুলি একটু হাসলেন। বললেন, “এতদিন হাতের রহস্য তোমাদের বলিনি। আজ বলতে বাধা নেই। প্রায় ষাট বছর আগে আলাস্কায় এক রাতে আমি তুষারঝড়ে পড়ে যাই। তেমন ব্লিজার্ড বোধ হয় খুব কমই হয়। পথ হারিয়ে কোন প্রান্তরে গিয়ে যে পড়েছিলাম, কে জানে! দু হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না। বাতাসের সে কী শোঁ-শোঁ শব্দ। প্রাণ যায়। প্রাণপণে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছি। কিন্তু শুনবে কে? ভগবানকে ডাকা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। যখন সব আশা জলাঞ্জলি দিয়ে ধীরে-ধীরে তুষারে কবরস্থ হয়ে যাচ্ছি, তখন কোথা থেকে একটা শক্তিমান হাত এসে আমাকে হাত ধরে তুলল, তারপর টেনে নিয়ে চলল। খানিক দূর নিয়ে গিয়ে সে একটা গোলাকার ঘরের মধ্যে আমাকে ঢুকিয়ে দিল। ঘরের মধ্যে বেশ গরম। আলো জ্বলছে। তখন দেখি, যে আমাকে এনেছে সে একটা কাটা হাত! আমি তো আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম। সেই সময়ে ঘরের ও পাশের একটা আবডাল থেকে বিরাট চেহারার একজন লোক বেরিয়ে এল। অত বড় মানুষ দেখা যায় না। সাত ফুট লম্বা তো হবেই, তেমনই দশাসই চেহারা। আমার দিকে চেয়ে প্রথমে অং বং করে কী বলল, কিছুই বুঝতে পারলাম না। খানিকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ পরিষ্কার বাংলায় বলল, “কোথায় যেতে চাও বলো, পৌঁছে দেব।’ কিন্তু বাংলা বললেও সে কস্মিনকালেও বাঙালি নয়। আমি তখন তাকে আমার ঠিকানা বললাম। তখন হঠাৎ সেই গোল ঘরখানা শুন্যে উঠে চলতে শুরু করল। ব্লিজার্ডে তার কিছু হল না। আমাকে জায়গামতো যখন নামিয়ে দিল, তখন হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কোথাকার লোক? লোকটা বলল, “আন উনো সাম্রাজ্যের। সে অনেক দূর। আমি তখন বললাম, এই কাটা হাতটা কি ভূত? সে বলল, “না। এটা এক অগ্রণী বিজ্ঞানের অবদান।’ আমি লোভে পড়ে বললাম, আমাকে দেবে? লোকটা হেসে বলল, “নেবে? নাও। কিন্তু ওটা তোমাদের ক্ষতিও করতে পারে।”
শশীবাবু একটু দম নিয়ে তারপর বললেন, “আমি বললাম, কী ক্ষতি করবে? লোকটা বলল, তোমার কাজ করার ইচ্ছে কমে যাবে, অলস হয়ে পড়বে। তবু নাও। তবে মনে রেখো, যখন দেখবে তোমার আয়ু শেষ হয়ে আসছে, তখন এটা নষ্ট করে ফেলো। আমি তোমাকে দু রকম মন্ত্র শিখিয়ে দিচ্ছি। একটাতে এটাকে ক্রিয়াশীল করা যাবে। দ্বিতীয় মন্ত্রটা প্রয়োগ করবে এটাকে ধ্বংস করার সময়। আজ সেই সময় উপস্থিত হয়েছে।”
সবাই সমস্বরে বলে উঠল, “না! না! না! না!”
শশী গাঙ্গুলি বললেন, “হাতটাকে ধ্বংস করে ফেলাই উচিত কাজ। তোমাদের তাতে ভালই হবে। দুঃখ কোরো না। পরনির্ভরতা যত কমে যাবে, তোমরা ততই শক্তপোক্ত হবে।”
শশীবাবু হাত বাড়াতেই শূন্য থেকে হাতটা তাঁর হাতে নেমে এল। তিনি শেষবারের মতো হাতটার গায়ে একবার হাত বুলিয়ে আদর করলেন। তারপর বিড়বিড় করে কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করলেন।
অমনই হাতটা শূন্যে উঠে একটা ডিগবাজি খেল। তারপর প্রচণ্ড শব্দে ফেটে শতখণ্ড হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তারপর সেই টুকরোগুলো আবার ফটাস-ফটাস করে ফেটে আরও ছোট-ছোট টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। তারপর সেই টুকরোগুলোও ফাটতে লাগল। ফাটতে-ফাটতে ক্রমে-ক্রমে অণু-পরমাণু হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। আর তার অস্তিত্ব রইল না।