“আছি। হাতে পিস্তল। সেপাইরা বেদির পেছনে লুকিয়ে আছে।”
“বাঃ।” রাজপুরোহিত চন্দ্ৰমাধব তাঁর লম্বা দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, “আমি জানি, দিনু বিশ্বেসকে অনেকেই পছন্দ করে না। কিন্তু আজ আমি তাদের সাবধান করে দিচ্ছি যে, কোনও হঠকারিতা করবেন না। দিনুর একখানা ঈশ্বরদত্ত জিনিস আছে। হঠকারিতা করলে রেহাই পাবেন না।”
সদাশিব বললেন, “আর তো সহ্য হচ্ছে না কবরেজমশাই!”
“আর একটু। রাজপুরোহিতটা কে বলুন তো! চেনা-চেনা লাগছে।”
“সে আমারও লাগছে। কিন্তু এখানকার লোক নয়।” চন্দ্রমাধব বললেন, “দিনু বিশ্বেস আজ রাজা হয়েছে, এ অতি আনন্দের কথা। কিন্তু আপনারা অনেকেই দিনু বিশ্বেসের অতীতকে জানেন না। কোন সামান্য অবস্থা থেকে সে আজ এক সংগ্রামী জীবনের ভেতর দিয়ে এতদূর পৌঁছেছে, তা রহস্যাবৃত অনেকেরই কাছে। আপনারা হয়তো জানেন না এই দিনু বিশ্বেস একসময়ে শশী গাঙ্গুলির বাড়িতে ভৃত্যের কাজ করত। একবার চুরি করে ধরা পড়ায়–”
দিনুর মুখখানা হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি উঠে। চন্দ্ৰমাধবকে চুপিচুপি কী যেন বলল। চন্দ্রমাধব বললেন, “আচ্ছা, আচ্ছা। সেসব কথা প্রকাশ করা দিনুর পছন্দ নয়। সুতরাং সেসব কথা আজ থাক।”
সবাই বলল, “সাধু, সাধু।”
চন্দ্রমাধব নিজের পাকা দাড়িতে হাত বোলাতে-বোলাতে বললেন, “দিনুর জীবনটাই এক সংগ্রামী জীবন। সেই সংগ্রামী জীবনের অনেকটাই তাকে কাটাতে হয়েছে জেলখানায়। অন্ধ কারার অন্তরালে
ফের দিনু উঠে চন্দ্ৰমাধবকে কী যেন বলল।
চন্দ্ৰমাধব সামলে গিয়ে বললেন, “সেকথাও আজ থাক। শুধু বলি, দিনুর কীর্তি আমাদের কাছে একটা দৃষ্টান্ত হয়েই থাকবে। কত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সে যে আজ এই রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে, তা ভাবলেও অবাক হতে হয়। যে হাতের জোরে সে আজ এত ওপরে উঠেছে, সেই হাতও সহজে তার হাতে আসেনি। নন্দ কবিরাজের নাতিকে চুরি করে…”
এবার দিনু আর থাকতে না পেরে পেল্লায় একটা ধমক দিল, “চুপ করুন তো ঠাকুরমশাই। ভীমরতি ধরেছে নাকি?”
“তাই তো! বুড়ো বয়সে মুখ বড় আলগা হয়ে যায় কিনা! তা সেসব গুহ্য কথাও আজ মুলতুবি থাক। আমি শুধু আজ দিনুকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করব।”
এই বলে চন্দ্ৰমাধব হাত বাড়িয়ে দিনুর মাথায় পরম স্নেহে হাত বোলাতে লাগলেন। বললেন, “দেখতে এইটুকু হলে কী হবে, সে একজন মস্ত মানুষ। ঠিক যেন ছোট্ট একটু বেলুন ফুলে এই এত বড় হয়েছে।”
শুনে সকলে হেসে উঠল।
দিনুর চোখ-মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল। চন্দ্রমাধব সেদিকে খেয়াল না করেই বললেন, “আজ আনন্দের দিনে দিনুর অতীত ইতিহাসকে টেনে না আনাই ভাল। সে-ইতিহাস হয়তো সকলের পছন্দ হবে না। কিন্তু আমি আজ দৃঢ়কণ্ঠে দিনুর বিরোধীদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তারা যেন হুট করে কিছু করে না বসেন। দিনু চোর বা জোচ্চোর হতে পারে, নানারকম পাপের কাজও করে থাকতে পারে, তবু সে কিন্তু আজ রাজা।”
দিনু আর সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে বলে উঠল, “ওরে হাত, আয় তো। এই ব্যাটা পুরুতের গলাটা টিপে ধরে দে তো ঘা কতক।”
আদেশমাত্র সাঁ করে হাত চলে এল শূন্যপথে। কিন্তু হাত কিছু করার আগেই কবরেজমশাই আর সদাশিব লাফিয়ে উঠলেন। সদাশিব পিস্তল বাগিয়ে ধরে বললেন, “সাবধান দিনু, খুলি উড়িয়ে দেব।”
কবরেজমশাই ধাঁ করে গিয়ে হাতটাকে চেপে ধরে বললেন, “কিছুতেই রাজপুরোহিতের কোনও ক্ষতি করতে দেব না। কিছুতেই না।”
নিয়ম অনুযায়ী ওই কালান্তক হাতের সঙ্গে নন্দবাবুর এটে ওঠার কথাও নয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, হাতটা তিনি চেপে ধরতেই হাতটা যেন তাঁর হাতে নেতিয়ে পড়ল।
চন্দ্ৰমাধব পাকা দাড়িতে হাত বোলাতে-বোলাতে সহাস্যে বললেন, “আজ বড় আনন্দের দিন। দিনু-চোর রাজা হবে। আপনারা সবাই তো তাই চান, নাকি?”
হঠাৎ সভাস্থলে অনেকেই গর্জে উঠল, “না, চাই না। ও লোকটা ভয়ঙ্কর বদমাশ।”
“বদমাশ!” চন্দ্ৰমাধব দিনুর দিকে চেয়ে বললেন, “তাই নাকি?”
নানা কণ্ঠ বলতে লাগল, “ও একটা শয়তান। ও ডাকাত। আমাদের ধান, চাল লুট করে নেয়। টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে যায়। দোকানের জিনিস তুলে নিয়ে যায়।”
দিনু লাফিয়ে উঠে চেঁচিয়ে তার হাতকে বলতে লাগল, “ওরে হাত, ম্যাদামারা হয়ে আছিস যে বড়। সব কটাকে পিটিয়ে ঢিট করে দিয়ে আয়। যা বলছি শিগগির।”
কিন্তু হাত কবরেজমশাইয়ের হাতে দিব্যি জমিয়ে বসে রইল। নড়ল না।
রাজপুরোহিত হাত তুলে সবাইকে শান্ত হতে ইশারা করে বললেন, “হাত তো দেখি দিনুর কথা শুনছে না। তা এইবেলা কি দিনুর মাথায় মুকুটটা পরাব? আপনারা কী বলেন?”
“নাঃ, নাঃ কক্ষনো না?”
দিনু কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ চারদিকের পরিস্থিতি বেগতিক দেখে বেদি থেকে একটা পেল্লায় লাফ মেরে পালানোর চেষ্টা করতেই সদাশিব তার ওপর গিয়ে পড়লেন। তারপর দু-তিনটে রদ্দা মেরে হাতে হাতকড়া পরিয়ে সেপাইদের হাতে দিয়ে বললেন, “সোজা লক আপে নিয়ে তোলো। আমি বাকি বদমাশদের দেখছি।”
চন্দ্ৰমাধব স্মিতহাস্যে বললেন, “আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে। যার দেখবার, সেই দেখবে।”
বলে চোখের একটা ইশারা করতেই কবরেজমশাইয়ের হাত থেকে শশীবাবুর হাত ছিটকে বেরিয়ে গেল এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে ভীম দাস, জটেশ্বর, গৌরহরি ইত্যাদি দশ বারোটা বদমাশকে আধমরা করে নিয়ে এসে, দমাস-দমাস করে বেদির ওপর ফেলল।