রতন বোস বিজ্ঞানের শিক্ষক, তিনি এসব গল্প শুনে নাক সিঁটকে বলেন, “ভূতপ্রেত, আত্মা বলে কিছু নেই। ওসব গাঁজাখুরি গল্প। আসলে হাতটা হল রোবট। পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক ব্যাপার। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিটলার একজন ইহুদি বৈজ্ঞানিককে আটক করে খুব অত্যাচার করেন। তারপর তাকে প্রাণের ভয় দেখিয়ে একটা আবিষ্কারের কাজে লাগান। হিটলারের খুব ইচ্ছে ছিল, চার্চিলের মোটা নাকে কষে একখানা ঘুসি বসান। কিন্তু চার্চিলের নাক তো আর তাঁর নাগালের মধ্যে নয়। তাই ওই হাতখানা তাঁর দরকার ছিল। ইহুদিদের বিজ্ঞানে খুব মাথা। সেই বৈজ্ঞানিক কয়েক মাসের চেষ্টায় এই আশ্চর্য হাত আবিষ্কার করে ফেললেন। কিন্তু বিপদ হল, একদিন হিটলার যখন বৈজ্ঞানিকের ল্যাবরেটরিতে হাতটা কতদূর হল জানতে গেছেন, তখন হাতটা পট করে লাফিয়ে উঠে হিটলারের নাকেই একখানা ঘুসি বসিয়ে দেয়। হিটলার তো প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বৈজ্ঞানিককে পাঠিয়ে দিলেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। হাতখানা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ডাস্টবিনে। শশীদা তখন জার্মানিতেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। যুদ্ধের বেড়াজালে আটকে পড়ে পালানোর পথ খুঁজছেন। হাতটা তিনিই একদিন কুড়িয়ে পেলেন। হাতটা যে সামান্য নয়, তা বুঝতে তাঁর দেরি হয়নি। হিটলার যে এরকম একটা কিছু আবিষ্কার করতে একজন বৈজ্ঞানিককে লাগিয়েছিলেন, তাও শুনেছিলেন। তখন তিনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে নাৎসি সোলজার সেজে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে গিয়ে সেই বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে দেখাও করেন। বৈজ্ঞানিক তাঁকে হাত সম্পর্কে সব শিখিয়ে-পড়িয়ে দেন। তবে তিনিও হাতটার কার্যকারিতা যে কতটা, তা ভাল করে বুঝে উঠতে পারেননি। দুঃখের বিষয়, সেই বৈজ্ঞানিককে সেইদিনই গ্যাস চেম্বারে পাঠানো হয়। হাতটার এলেম বুঝতে এবং শিখতে শশীদার আরও কয়েকদিন সময় লেগেছিল। নইলে ওই হাত দিয়েই বৈজ্ঞানিককে উদ্ধার করতে পারতেন। শুধু তাই নয়, ওই হাতখানা দিয়েই হিটলারকে তাঁর নাৎসিবাহিনী-সহ জব্দ করা যেত।”
কুঞ্জপুকুরের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটি হলেন মহিম ঘোষ। একশো পনেরো পার হয়ে ষোলোয় পড়েছেন। তিনি বলেন, “ওরে, চার্চিলের নাকখানাই এমন যে, সকলেরই ঘুসি মারতে ইচ্ছে করবে। তাই বলে ওই রোবটের গল্পটা আবার তোরা বিশ্বাস করে বসিসনি। ও কার হাত, সবাই না জানলেও আমি জানি। জাদুকর রাখহরি মজুমদার ছিলেন নমস্য পুরুষ। কী যে মারাত্মক খেলা দেখাতেন, তা বলার নয়। অশৈলী সব কাণ্ডকারখানা। সাগরদিঘির জল এক চুমুকে খেয়ে ফেললেন। আকাশে সবুজ মেঘ ভাসিয়ে আনলেন। শূন্যে পায়চারি করা তো ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। হাতখানা তাঁরই। রাখহরি মজুমদার শেষ যে-খেলাটা দেখিয়েছিলেন সেটা হয়েছিল ওই কুঞ্জপুকুরেই। হাই স্কুলের মাঠে শামিয়ানা টাঙিয়ে খেলা হচ্ছিল। দুর্দান্ত-দুর্দান্ত সব ম্যাজিক দেখানোর পর বললেন, ‘এইবার আমার শেষ খেলা। বলে স্টেজের মাঝখানে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর একে-একে তাঁর সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খসে-খসে পড়ে যেতে লাগল, মুণ্ডু গেল, হাত গেল, পা গেল, বুক আর পেট কিছুক্ষণ শুন্যে ভেসে থেকে তারপর খসে পড়ল। শুধু গলার স্বরটা শোনা গেল, রাখহরি বলছিলেন, “আমার মৃত্যু নেই। আমি পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেলাম। বাস্তবিকই তাই, আমরা হুড়মুড় করে স্টেজে উঠে দেখলাম, একমাত্র ডান হাতের পাঞ্জাখানা ছাড়া আর কিছুই নেই। সব অদৃশ্য। রাখহরিকে আর পৃথিবীতে দেখাও যায়নি কখনও। ওই হাতখানা গোলেমালে কুড়িয়ে নিয়েছিল আমাদের শশীভায়া। তাতে দস্তানা পরিয়ে নিয়েছে, এই যা। রাখহরি মজুমদারই এই হাতখানায় মাঝে-মাঝে ভর করে।”
শশীদাদুর হাত নিয়ে আরও নানা ধরনের গল্প প্রচলিত আছে। কোনটা সত্যি, কোনটা নয়, কে বলবে? হাতের রহস্য যা-ই হোক, হাতটা এখানকার মানুষের পরম বন্ধু। কেউ কোনও মুশকিলে পড়ে শশীদাদুর কাছে গিয়ে হাজির হলেই হল, শশীদাদু অমনই তাঁর হাতটাকে মুশকিল আসান করতে পাঠিয়ে দিতেন।
ওস্তাদ বিলু খাঁ সেবার পাশের গাঁ হরিহরপুরে জমিদারবাড়িতে গান গাইতে এলেন। কিন্তু গানের দিন সকাল থেকেই তাঁর তবলচির ম্যালেরিয়া। সে কাঁপতে কাঁপতে সাতখানা লেপ চাপা দিয়ে চি-চি করছে। অথচ এদিকে আসর-ভর্তি সব গণ্যমান্য লোক। বহু দূর-দূর থেকে সব এসেছেন। কিন্তু তবলচি ছাড়া গান হবেই বা কী করে? আসরে দু-চারজন তবলচি যে না ছিল, তা নয়, তবে তারা বিলু খাঁর সঙ্গে বাজানোর সাহস রাখে না। একজনকে ধরেবেঁধে তবলায় বসানো হল বটে, কিন্তু বাঘা ওস্তাদ বিল্ল খাঁয়ের ভয়ে তাঁর দাঁতে-দাঁতে এমন খটখটি হতে লাগল যে, বাধ্য হয়ে তাকে তুলে দিতে হল। এদিকে তবলচির অভাবে আসর পণ্ড হওয়ার জোগাড়। জমিদার রাঘব রায়চৌধুরী তখন শশীদাদুকে ডেকে বললেন, “আপনি না বাঁচালে আর উপায় নেই। আমার লজ্জায় মাথাকাটা যাবে।”
শশীদাদু বললেন, “তবলা বাজাতে তো দুটো হাত লাগে, আমার তো মোটে একটা হাত। দেখা যাক চেষ্টা করে।”
তা হাত তো চলে এল। কিন্তু হাত দেখে ওস্তাদজি এমন হাঁ হয়ে গেলেন যে, আধঘণ্টা তাঁর গলা দিয়ে শব্দই বেরোল না। পরে তাঁকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে শরবত-পান ইত্যাদি খাইয়ে একটু সুস্থ করে তোলা হল। গানও তিনি ধরলেন বটে, কিন্তু সুর লাগাতে পারছিলেন না। কিন্তু যখন তবলায় বোল ফুটতে শুরু করল তখন ওস্তাদজীর গানেও সুর লেগে গেল। একখানা হাত যে একই সঙ্গে ঝড়ের গতিতে তবলা আর ডুগিতে যাতায়াত করে এরকম দুরূহ বোল তুলতে পারে, তা চোখে না দেখলে এবং কানে না শুনলে বিশ্বাস হওয়ার কথাই নয়। গানের শেষে ওস্তাদজী খুশি হয়ে বললেন, “বহু তবলচি দেখেছি, কিন্তু এরকম সঙ্গত আর পাইনি।”