“ধুর মশাই, কোথায় কী? আমাকে তো বীরের কাজ কিছু দেওয়াই হয় না। কেবল এটা আন, ওটা দিয়ে আয়, অমুককে একটা খবর দে, একটা পান সেজে আন, এইসব।”
“তা হলে তো খুবই দুঃখের কথা!”
“খুবই দুঃখের। একটু আদর-যত্নও তো পাওয়া যায় না। পান থেকে চুন খসলেই দাবড়ায়।”
“তা হলে তো আফসোসের কথাই ঝিকু। এভাবে তো চলবে না।”
“চলছে না মশাই, একদম চলছে না। আগেই ভাল ছিলুম।”
“আগে কী করতে বাপু?”
“বাপের জমি আছে। চাষবাস করতুম। বেশ ছিলুম তখন। দিনুদাদা গিয়ে কানমন্ত্র দিয়ে নিয়ে এল। রাজা হল বটে, কিন্তু সে তো নিজের এলেমে নয়, শশীবাবুর হাতের দৌলতে, রাজা হয়েই একেবারে ধরাকে সরা দেখতে লেগেছে, এখন কাদের খাতির জানেন? ওই ভীম সর্দার, গৌরহরি, জটেশ্বর, এরাই সব পেয়ারের লোক। আমি যেন ভেসে এসেছি।”
এই বলে ঝিকু একখানা চিঠি বের করে কবরেজমশাইয়ের হাতে দিয়ে বলল, “আপনাকেও কোন ফেরেববাজিতে ফেলে দেখুন। রাজবৈদ্য হতে ডেকেছে। দু হাজার টাকা মাইনে আর উপরি। দু’ হাজার টাকা মাইনে আমারও, কিন্তু আজ অবধি দুশোটি টাকাও পাইনি। যা পাচ্ছে, সব রাজকোষে জমা করে নিচ্ছে। আপনার বেলাতেও তাই হবে দেখবেন।”
কবরেজমশাই চিঠি খুলে দেখলেন, দিনুরাজা পরম বিনয়ের সঙ্গে শতকোটি প্রণাম জানিয়ে তাঁকে রাজবৈদ্য হিসেবে নিয়োগ করতে চেয়েছে। কবরেজমশাই চিঠিটা রেখে দিয়ে বললেন, “দিনুকে বোলো, অভিষেকটা ভালয় ভালয় হয়ে যাক, তারপর রাজবৈদ্যের চাকরি নেব। অভিষেকে তো যাচ্ছিই, তখন কথা হবে।”
“যে আজ্ঞে! আচ্ছা কবরেজমশাই, এটা কেমন নিয়ম বলুন তো! রাজামশাইয়ের সব কর্মচারীরই মাইনে দু হাজার টাকা করে? কেউ অবশ্য দু হাজার পায় না। কিন্তু বলা তো থাকছে।”
“খুব আশ্চর্য কথা! যেখানে মুড়ি-মিছরির এক দর, সেখানে খুব অরাজকতা বলেই ধরতে হবে। তা, রাজবাড়িতে খাওয়াদাওয়া কেমন?”
“সে আর বলবেন না। রাজা হওয়ার পর থেকেই দিনুদাদা এমন কেপ্লন হয়েছে যে, ডাল, ভাত আর ঘাট ছাড়া কর্মচারীদের আর কিছু জুটছে না। ওদিকে হাত বাবাজিকে রোজই এখান থেকে সেখান থেকে চুরি-জোচ্চুরি করে আনার কাজে লাগাচ্ছে। কয়েক দিনে লাখো লাখো টাকা করে ফেলল মশাই! যত দেখি। তো রক্ত গরম হয়ে যায়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, দিই তলোয়ারের একটা কোপ বসিয়ে ঘাড়ে, তারপর যা হওয়ার হবে। কিন্তু ভয় ওই হাত বাবাজিকে। গোবিন্দ কী একটু বেয়াদবি করেছিল, হাত বাবাজির কী উস্তম কুস্তম মার! যায়-যায় অবস্থা। ফটিককে এই শীতের রাতে পুকুরে চুবিয়ে আনল। অপরাধ কী, না সে খিদের মুখে, একটা কলা চুরি করে খেয়েছে। রাজামশাইয়ের খাওয়ার সময় কাজের লোক হাঁচি দিয়েছিল মশাই, তাকে চুল ধরে একটি ঘণ্টা শূন্যে ঝুলিয়ে রেখেছিল। অত্যাচারের শেষ নেই। চাষিদের ঘরের ধান, চাল, সবজি, দুধ, মাছ, সব ওই হাত বাবাজিকে দিয়ে কেড়ে আনছে। তল্লাটের সব দোকানপাট লুট হয়ে গেছে। লোকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালানোর পথ খুঁজছে।”
“তোমরা তবু চুপ করে আছ?”
“কী করব কবরেজমশাই! ওই হাত বাবাজির ভয়ে কিছু করার উপায় নেই কিনা!”
কবরেজমশাই যত শুনছেন, তো ভেতরে-ভেতরে খুশি হচ্ছেন। এই তো চাই। এ রকমই তো চাই। তিনি ভাল করে ঝিকুকে মণ্ডা-মিঠাই খাইয়ে বিদায় দেওয়ার সময় কানে কানে বললেন, “প্রস্তুত থেকো, অভিষেকের দিন সুযোগ আসবে।”
“যে আজ্ঞে!”
অভিষেকের দিন এগিয়ে আসতে লাগল। সদাশিববাবু তাঁর সেপাইদের নিয়ে রোজ লেফট রাইট করছেন। ডন-বৈঠক কসরত চলছে। ঘরে-ঘরে পাঁচন পৌঁছে যাচ্ছে। দিনু-বিরোধীরা গায়ে বেশ জোর এবং ফুর্তি পাচ্ছেন।
দেখতে না দেখতেই মাঘী পূর্ণিমা এসে পড়ল। দশটা গাঁয়ের লোক সেজেগুঁজে ভোর থাকতেই রওনা হয়ে পড়ল রাজবাড়ি।
৬. রাজবাড়ি দেখে সকলেই থ
রাজবাড়ি দেখে সকলেই ‘থ’। চারদিকে জঙ্গল হাসিল করে বিরাট সাতমহলা বাড়ি উঠেছে। প্রাসাদের মাথায় সোনার চুড়ো। চারদিকে ফুলের বিরাট বাগান। মস্ত দিঘি। মৃগদাব। হাতিশালে হাতি। আস্তাবলে ঘোড়া। চারদিক ঝকঝক, তকতক করছে। বিশাল শামিয়ানার নিচে অতিথিদের জন্য সার-সার চেয়ার। নিচে গালিচা বিছানো। একটা বেদির ওপর নতুন সোনার মুকুট। সোনার রাজদণ্ড। গোলাপজল আর আতরের গন্ধে চারদিক মাত।
বিশিষ্ট গণ্যমান্য অতিথিদের চেয়ারে বসানো হল। সাধারণ লোরো বাইরে দাঁড়িয়ে রইল ভিড় করে। ঘন-ঘন দিনুরাজার নামে জয়ধ্বনি উঠছে। রাজকর্মচারীদের ছোটাছুটির বিরাম নেই।
বেলা দশটা বাজতেই দিনুরাজা এসে সিংহাসনের পাশে একটা নিচু আসনে বসল। চারদিক ফেটে পড়ল জয়ধ্বনিতে। দিনুরাজা হাসি-হাসি মুখ করে হাত তুলে সকলের অভিনন্দন গ্রহণ করল।
এর পরই উঠলেন রাজপুরোহিত চন্দ্ৰমাধব। লম্বা, রোগাটে চেহারা। দুধসাদা দাড়ি-গোঁফ, শ্বেতশুভ্র লম্বা চুল। তাঁর চেহারাটা অনেকেরই চেনা-চেনা মনে হল। কিন্তু শোনা গেল, ইনি এ-অঞ্চলের লোক নন। তিব্বত থেকে এসেছেন। মস্ত সাধক। শশীবাবুর হাতই তাঁকে সংগ্রহ করে এনেছে।
স্বস্তিবাচন পাঠের পর চন্দ্ৰমাধব জলদ গম্ভীর স্বরে বললেন, “আজ বড় আনন্দের দিন। আজ আমাদের দিন বিশ্বে এই রাজ্যের রাজা হচ্ছেন।”
তুমুল হর্ষধ্বনি।
দিনু-বিরোধীদের নিয়ে কবরেজমশাই সামনের দিকে দ্বিতীয় সারিতে বসে ছিলেন। কবরেজমশাই পাশে বসা সদাশিবকে কনুই দিয়ে একটা ঠেলা দিয়ে বললেন, “তৈরি থাকবেন।”