এই দৃশ্য দেখে অনেকেই সোল্লাসে জয়ধ্বনি দিল, “জয় দিন মহারাজের জয়!”
আবার অনেকে মুখ কালো করে আড়ালে সরে পড়ল। দিনুরাজার উড়ন্ত সিংহাসন প্রথমেই এসে নামল কুঞ্জপুকুরের চণ্ডীমণ্ডপের সামনে। মুহূর্তের মধ্যে চারদিক ভিড়ে ভিড়াক্কার হয়ে গেল। সবাই দেখতে পেল, সিংহাসনটা ধরে রয়েছে শশীদাদুর সেই বিখ্যাত হাত।
দিনুরাজা সবাইকে হাতজোড় করে নমস্কার করে মিঠে মোলায়েম গলায় বলল, “ভাইসব, আপনারা আমার অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আপনাদের পাঁচজনের আশীবাদ আর শুভেচ্ছায় চারদিকে আজ শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করছে। চুরি, ছ্যাচড়ামি, ডাকাতি, রাহাজানি, গুণ্ডামি সব বন্ধ। রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হতে আর দেরি নেই। এটা জনগণেরই জয়, আমি আপনাদের সামান্য সেবক হিসেবে আমার সামান্য সীমায়িত ক্ষমতায় যেটুকু করতে পেরেছি, তাও আপনাদেরই সহযোগিতায়। জনগণেরই বিশেষ অনুরোধে নিতান্তই অনিচ্ছায় আর ঠিক কুড়ি দিন বাদে মাঘী পূর্ণিমার দিন এই অধমকে জনগণ সিংহাসনে অভিষিক্ত করবেন বলে মনস্থ করেছেন। রাজার মুকুট মাথায় দেওয়া মানে আসলে কাঁটার মুকুট পরা। তবু আমি আপনাদের মুখ চেয়ে রাজি হয়েছি। ওইদিন আপনারা আপামর জনসাধারণ দয়া করে অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন, এই প্রার্থনা। কুঞ্জপুকুরে নেমন্তন্ন করতে আমি নিজেই এসেছি, কারণ এই গ্রামের সঙ্গে আমার অনেক সুখ-দুঃখের স্মৃতি জড়িয়ে আছে।”
সবাই জয়ধ্বনি করল, হাততালিও পড়ল। হাসি-হাসি মুখে দিনুরাজা ফের সিংহাসনে বসল। সিংহাসন শূন্যে উঠে ভেসে চলে গেল!
একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সদাশিব দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, “দেখলেন কবরেজমশাই?”
কবরেজমশাই বললেন, “দেখলাম। আঙুল ফুলে কলাগাছ!”
“ইচ্ছে করছিল পিস্তলটা তুলে গুলি চালিয়ে দিই।”
“তাতে লাভ হত না, পিস্তল তুলবার আগেই হাত এসে পিস্তল কেড়ে নিত। গুলি চালাতে পারলেও দিনুর গায়ে লাগত না, সে বেঁটে মানুষ, লোকজন ঘিরে ছিল তাকে। মাথা ঠাণ্ডা রাখুন সদাশিববাবু।”
“যে আজ্ঞে। আজ সকালে আমি মাইলটাক দৌড়েছি। খাওয়া অর্ধেক করে ফেলেছি, ডন-বৈঠক শুরু করে দিয়েছি।”
“খুব ভাল।”
“আর দিনু-বিরোধী লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগও করে ফেলেছি। আজ রাত বারোটার পর চণ্ডীমণ্ডপে মিটিং। অন্ধকারেই মিটিং হবে।”
“বাঃ, আপনি তো আগের মতোই করিৎকর্মা হয়ে উঠেছেন।”
“যে আজ্ঞে।”
.
নিশুতরাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ল। কুয়াশায় চারদিক আবছা। তার মধ্যেই গুটিগুটি বারো-চোদ্দজন লোক এসে অন্ধকার চণ্ডীপণ্ডপে জড়ো হল। সকলেই কেমন মনমরা, হতাশ আর জবুথবু।
কবরেজমশাই উঠে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বললেন, “আপনাদের মনের অবস্থা আমি জানি। আমরা সবাই আজ এক বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছি। আগে আমার একটা অপরাধের কথা স্বীকার করে নিই।”
সবাই অন্ধকারেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কবরেজমশাই অকম্পিত কণ্ঠে তাঁর নাতির জন্য হাত চুরি করা এবং তা দিনুর হাতে তুলে দেওয়ার বৃত্তান্ত খোলসা করে বললেন। কিছুই লুকোলেন না, সবশেষে বললেন, “অপরাধ আমার। প্রায়শ্চিত্তও আমাকেই করতে হবে। দিনুর অভিষেকের দিনটাকেই আমার পছন্দ। আমার অনুরোধ, আপনারাও সকলে ওইদিন অভিষেকে উপস্থিত থাকবেন। যা হওয়ার ওইদিনই হবে।”
কে একজন মুখ ঢেকে বসে ছিল একটা থামের আড়ালে, সে হঠাৎ ফ্যাঁসফ্যাসে গলায় বলল, “আপনার নাতি কি ফেরত এসেছে?”
“না। তার আশা ছেড়ে দিয়েছি, দিনু তাকে দুশো টাকায় বেদেদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। সেই বেদের দল এ তল্লাট ছেড়ে কোথায় চলে গেছে, কেউ জানে না।”
সবাই চঞ্চল হয়ে উঠল। অনেকেই ক্রোধ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করতে লাগল। কবরেজমশাই শান্ত কণ্ঠে বললেন, “আমারই পাপের শাস্তি। আপনারা উত্তেজিত হবেন না। তবে সকলেই প্রস্তুত থাকুন। যাঁরা এখনও দিনুর কাছে মাথা নোয়াননি, তাঁরা দয়া করে মাথা নোয়াবেন না। ভরসা রাখুন। ঠাকুর মঙ্গলময়।”
মিটিংয়ের পর কবরেজমশাই সদাশিবকে জিজ্ঞেস করলেন, “থামের আড়ালে মুখ ঢেকে একটা লোক বসে ছিল, আমাকে আমার নাতির কথা জিজ্ঞেস করল। কে বলুন তো?”
“আমিও ঠিক চিনতে পারলাম না। মিটিং শেষ হওয়ার আগেই সরে পড়ল।”
“দিনুর স্পাই নয় তো?”
সদাশিব দুশ্চিন্তায় পড়ে বললেন, “আশ্চর্যের কী? হতেই পারে।”
কবরেজমশাইয়ের কয়েকদিন নাওয়া-খাওয়া রইল না। নানারকম পাঁচন তৈরি করে দিনু-বিরোধীদের বাড়ি বাড়ি পাঠাতে লাগলেন।
একদিন সকালবেলা ঝলমলে পোশাক-পরা ঝিকু ঘোড়ায় চেপে এসে হাজির হল।
“পেন্নাম হই কবরেজমশাই, দিনুমহারাজ পাঠালেন।”
কবরেজমশাই স্মিতহাস্যে বললেন, “কী খবর হে ঝিকু কোটাল?”
“আজ্ঞে, খবর সুবিধের নয়। যত রাজ্যের গুণ্ডা বদমাশ এসে রোজ ভিড় করছে। আমি তেমন পাত্তাই পাচ্ছি না। মহারাজের ফাঁইফরমাশ খেটে খেটে জান কয়লা হচ্ছে। এই কি কোটালের কাজ, কবরেজমশাই? ছ্যাঃ ছ্যাঃ।”
কবরেজমশাই আদর করে ঝিকুকে ঘরে এনে বসালেন। বললেন, “বোসো, বোসো, একটু জিরিয়ে নাও।”
তা ঝিকু বসল, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কোটালের কাজ ঝিকু বিশেষ পছন্দ করছে না। কপালের ঘাম মুছে বলল, “কোটাল মানে কি ভৃত্য নাকি কবরেজমশাই? ওসব শক্ত-শক্ত কথা, মানেও জানি না!”
“না হে, কোটাল ভৃত্য হবে কেন? মস্ত সম্মানের কাজ। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে রাজার সমানই, সে হল আইনের রক্ষক। মানুষের ধনপ্রাণ তো সেই রক্ষা করে। বীরকে বীর, সাহসীকে সাহসী।”