“আপনি কি দিনুর জাবদা খাতায় নাম লিখিয়ে এসেছেন নাকি?”
সদাশিব কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন, “কী করব কবরেজমশাই! বদলির দরখাস্ত করেছিলাম, তা সরকারবাহাদুর আমার দরখাস্ত নামঞ্জুর করে দিয়েছেন। এ তল্লাটে যদি থাকতেই হয়, তা হলে দিনুরাজার কাছে মাথা না মুড়িয়ে থাকব, আমার ঘাড়ে কটা মাথা? জানেন তো, দিনুরাজা যে জায়গায় রাজবাড়ি করেছেন, তার দু’জন দাবিদার এসে হাজির হয়েছিল। দিনুরাজার পাইক বরকন্দাজরা তাদের গান নিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে গিয়েছিল। তারা তখন চি-চি করতে করতে গোটা জমিটা দিনুরাজার নামে দানপত্র লিখে সই করে দিয়ে গেছে। নয়াগঞ্জের কুস্তিগির বীরবাহাদুর নজরানা না নিয়ে দিনুরাজার সামনে গিয়েছিল বলে তাকে কান ধরে পাবলিকের সামনে ওঠাবসা করানো হয়েছে। শুনতে পাচ্ছি, শশীবাবুর হাতটা নাকি এখন দিনুরাজার হাতে। তার জোরেই এতসব হচ্ছে। তা, নাম না লিখিয়ে কী করি বলুন!”
কবরেজমশাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তা হলে দৌবারিক কথাটার মানে না জানাই আপনার পক্ষে ভাল। গাঁয়ের লোকও বেশিরভাগই মানেটা জানে না। চাকরিটা বরং নিয়েই ফেলুন।”
“মানেটা কি খুব খারাপ কবরেজমশাই?”
“মাইনেটা যদি ভাল হয়, তা হলে মানেটা খারাপ হলেই বা কী যায়-আসে?”
সদাশিব একগাল হেসে বললেন, “আজ্ঞে, মাইনেটা খুবই ভাল। আপাতত দু হাজার টাকা। উপরি আছে। ক্ষমতাও মেলা।”
“তা হলে আর কী! লেগে যান কাজে।”
“আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে একটু যেন রেগে আছেন। তা আমি বলি কি কবরেজমশাই, রাগটাগ করে লাভ নেই। অবস্থা বুঝেই তো ব্যবস্থা করতে হয়। শশীবাবুর হাতটা কীভাবে দিনুরাজার হাতে চলে গেল, তা আমরা জানি না। কিন্তু যখন গেছে, তখন হাকিম সাহেবের হুকুম না মেনে কি উপায় আছে? বলুন আপনি।”
কবরেজমশাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “শশীবাবুর হাত আজ খারাপ একটা লোকের হাতে গেছে বলেই কি আমাদেরও খারাপ হতে হবে সদাশিববাবু?”
সদাশিব একটু বিমর্ষ হয়ে বললেন, “শুধু আমাকেই কেন দুষছেন কবরেজমশাই? আপনি কি জানেন, স্কুলের হেডস্যার হয়েছেন দিনুরাজার শিক্ষামন্ত্রী, হেডপণ্ডিতমশাই গতকালই দিনুরাজার সভাপণ্ডিতের চাকরিতে জয়েন করেছেন, বিজ্ঞানের মাস্টার রতন বোস হয়েছেন সভা-প্রযুক্তিবিদ। দিনুরাজা একটা উড়ন্ত চেয়ারে বসে মাঝে-মাঝে গগনপথ থেকে তাঁর রাজ্যের এরিয়েল সার্ভে করবেন। রতন বোস তাঁর চেয়ারে সিটবেল্টের ব্যবস্থা করছেন। দশটা গাঁয়ের আরও কত মানুষ চাকরির আশায় দিনুরাজার দরবারে ঘুরঘুর করছে, তার হিসেব নেই।”
কবরেজমশাই একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “বটে!”
“শুনছি, আপনাকে রাজবৈদ্য করার প্রস্তাব নিয়ে লোক এল বলে!”
কবরেজমশাইয়ের মুখটা রক্তাভ হয়ে গেল রাগে। দাঁতে দাঁত পিষে বললেন, “পাষণ্ডটা আর কী করতে চায়?”
সদাশিব একটু হেসে বললেন, “দিনুরাজা মনে করেন, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি আনঅর্গানাইজড ক্রাইম। ওতে সমাজে বিশৃঙ্খলাই বাড়ে। তাই তিনি একটা সংগঠিত দল তৈরি করছেন। যারা নিয়মিত নজরানা এবং খাজনা দেবে, তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করা হবে না। কিন্তু যারা তা দেবে না, তাদের ঘটিবাটি চাঁটি করার সংগঠিত ব্যবস্থা হবে। যারা তবু বশ মানবে না, তাদের রাজদরবারে নিয়ে গিয়ে বিচার করা হবে। জেল, জরিমানা, বেত্রাঘাত, শূল, সব ব্যবস্থাই হচ্ছে।”
কবরেজমশাই এবার আরও একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “কথাটা এতক্ষণ বলতে একটু বাধোবাধ ঠেকছিল। কিন্তু মনে হচ্ছে, বলে দেওয়াই ভাল। শুনতে যখন চাইছেন তখন বলি, “দৌবারিক’ কথাটার মানে হল দরোয়ান।”
“দরোয়ান?” বলে সদাশিব হাঁ হয়ে রইলেন। কবরেজমশাই উঠে গিয়ে বাংলা অভিধানটা নিয়ে এসে খুলে দেখিয়ে বললেন, “আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তো এই দেখুন। এখন ভেবে দেখুন, দারোগা থেকে দরোয়ান হতে আপনার কেমন লাগবে…?”
সদাশিব অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে অভিধানের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ লাফিয়ে উঠে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “কী! আমাকে এত বড় অপমান! এখনই আমি ব্যাটাকে ধরে থানায় এনে লক-আপে পুরে দিচ্ছি।”
কবরেজমশাই অনুত্তেজিত গলায় বললেন, “মাথা গরম করবেন। তাতে কাজ পণ্ড হবে। ঠাণ্ডা হয়ে বসুন।”
সদাশিব কুদ্ধ গলায় বললেন, “এর পরও ঠাণ্ডা হতে বলছেন? কী স্পর্ধা দেখছেন লোকটার?”
“দেখছি। তবু মাথা গরম করবেন না। মনে রাখবেন, লোকটার হাতে শশীবাবুর হাত আছে। আমাদের সাধ্য নেই তার সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করার। কিন্তু কৌশলে সবই হয়।”
“আমাকে কী করতে বলেন আপনি?”
কবরেজমশাই গম্ভীর হয়ে বললেন, “গায়ের জোর বাড়াতে বলি। আজ থেকেই খাওয়াদাওয়া ছাঁটকাট করতে হবে। রোজ ব্যায়াম করতে শুরু করুন। যখন প্রথম এ তল্লাটে এসেছিলেন, তখন আপনার বেশ মুগুরভাঁজা চেহারা ছিল। মুগুর আবার ধরুন। আর যারা এখনও দিনুর দলে নাম লেখায়নি তাদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করতে থাকুন। আমাদেরও জোট বাঁধার সময় এসেছে।”
“যে আজ্ঞে!”
“চণ্ডীমণ্ডপে কালই আমরা মিটিং করব। একটু বেশি রাতের দিকে। বুঝলেন?”
সদাশিব এখনও রাগে গরগর করছেন, বললেন, “যে আজ্ঞে।”
রাগে ফুঁসতে ফুসতে সদাশিব বিদায় নিলেন।
পরদিন সকালবেলায় দশ গাঁয়ের লোক অবাক হয়ে দেখল শূন্যপথে খুব ধীরে ধীরে একটা সিংহাসনের মতো জিনিস ভেসে যাচ্ছে। তাতে বসে আছে দিনুরাজা। পরনে জরির পোশাক, মাথায় ঝলমলে মুকুট, হাতে একটা রাজদণ্ড আর মুখে একটু হাসি। ওপর থেকে সে মাঝে মাঝে বরাভয়ের ভঙ্গিতে হাত তুলছিল।