নন্দ কবিরাজ অবাক হয়ে বললেন, “অপঘাতে?”
এবার তান্ত্রিক তাঁর দিকে চেয়ে বললেন, “তুমি কে গো খোকাটি?”
ক্ষান্তমণি বলল, “উনি কবরেজমশাই। বাবার চিকিৎসা উনিই করছিলেন।”
“বাঃ বাঃ। তা এসো, দেখে যাও শশীকে। তোমার চিকিৎসা তো কাজে লাগল না বাবা, শশীকে আজ ভোররাতে কে যেন গলা টিপে মেরে রেখে গেছে। গলায় আঙুলের দাগ একেবারে স্পষ্ট।”
নন্দ কবিরাজ ঠকঠক করে কাঁপছিলেন। গ্লানিতে তাঁর ভেতরটা ভরে যাচ্ছে। কোনওক্রমে গিয়ে শশীবাবুর নাড়িটা দেখলেন। নেই। নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখলেন। খাস চলছে না। গলাটা একটু ঝুঁকে দেখলেন। কাঁপুনি আরও বেড়ে গেল। গলায় মোটা-মোটা আঙুলের স্পষ্ট দাগ। ও হাত যে কোন হাত, তা তাঁর চেয়ে ভাল আর কে জানে!
তান্ত্রিক বললেন, “তোমরা আর মরা মানুষের ঘরে ভিড় কোরো না। শশীর অপঘাতে মৃত্যু হওয়ায় আমি ওর মৃতদেহ কিছু সংস্কার করব, যাতে ওর আত্মার সদগতি হয়। অন্তিম সংস্কারও আমিই করব। আমার চারজন চেলা বাইরে অপেক্ষা করছে, তারাই আজ রাতে শ্মশানে নিয়ে যাবে।
নন্দ কবিরাজ কাঁপতে কাঁপতে এবং কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এলেন। দুঃখের মধ্যে একটাই আশার আলো। এবার হয়তো বদমাশ দিনু বিশ্বাস তাঁর নাতি বালুকে ফেরত দেবে।
সকালবেলায় যখন একজন ঘোড়সওয়ার এসে গাঁয়ে দিনুর রাজা হওয়ার কথা ঘোষণা করতে লাগল, তখন কবরেজমশাই বুঝতে পারলেন, হাতটাকে দিনু সত্যিই কাজে লাগিয়ে ফেলতে পেরেছে। এর পরিণাম যে কী ভয়াবহ, তা ভেবে শিউরে উঠলেন তিনি। নিজের অবিমৃশ্যকারিতাকে ধিক্কার জানাতে লাগলেন বারবার।
লোকটা যখন কুঞ্জপুকুরে চক্কর দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল, তখন বাঁশবনের কাছে তাকে ধরলেন নন্দ কবিরাজ। পথ আটকে দাঁড়িয়ে বললেন, “ওহে বাপু, তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।”
ঝিকু ঘোড়া থামিয়ে বলল, “বলুন কবরেজমশাই।”
“দিনু আমার নাতিকে চুরি করেছিল। দুটো শর্তে ফেরত দেওয়ার কথা। শর্ত দুটোই পূরণ হয়েছে। কিন্তু আমার নাতি কই?”
ঝিকু ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল। তারপর কাছে এসে চাপা গলায় বলল, “এরকম আহাম্মক নোক আর দেখিনি, বুঝলেন। একেবারে আকাট।”
“কে? কার কথা বলছ?”
ঝিকু গলা আরও এক পরদা নামিয়ে বলল, “দিনুদাদার কথাই বলছি। রাজা-গজা মানুষ, প্রকাশ্যে তাঁর নিন্দে করলে গদান যাওয়ার ভয় আছে। তবু না বলেও পারছি না। অমন ফুটফুটে নাতি আপনার। ওর দাম কি মোটে দুশো টাকা?”
নন্দ কবিরাজ হাঁ হয়ে গিয়ে বললেন, “কী বলছ বাপু?”
“সেই কথাই তো বলছি। ওরকম ছেলের এ বাজারে হেসে-খেলে দু থেকে পাঁচ হাজার টাকা অবধি দর উঠবে। আর ৬৮
দিনুদাদা মাত্র দুশো টাকায় বেদেদের কাছে বাচ্চাটাকে বিক্রি করে দিল!”
নন্দ কবিরাজ কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “বেদেদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে? বেদেদের কাছে…”
“বলে কিনা, উটকো ঝামেলা ঘাড়ে রাখতে চাই না, তাই শস্তায় বেচে দিলাম। সে না হয় হল। কিন্তু দরটা অমন কম করে বলার মানে হয়? আপনিই বিবেচনা করে দেখুন না, আপনারই তো নাতি, হেসে-খেলে দুটি হাজার টাকা আদায় হত না? এই বুদ্ধি নিয়ে উনি চালাবেন রাজত্ব! তবেই হয়েছে।”
কিন্তু নন্দ কবিরাজের কানে ঝিকুর আর কোনও কথাই ঢুকল না। তিনি মূৰ্ছিত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
ঝিকু মাথা নেড়ে বলল, “দুঃখ হওয়ারই কথা। অমন নাতি এত শস্তায় বিক্রি হয়ে গেছে শুনলে কোন দাদুর না দুঃখ হয়?”
এই বলে ঝিকু ঘোড়ায় চেপে চলে গেল।
মূর্ছা ভেঙে নন্দ কবিরাজ উঠলেন আরও আধঘণ্টা পরে। শরীরটা কাঁপছে। মন ভারাক্রান্ত। বুকও ভার হয়ে গেছে। ভাবলেন, বাড়ি ফিরে গিয়ে বিষ খাবেন আজ। তারপর ভাবলেন, নিজের কর্মদোষে যখন এত ঝামেলা পাকিয়ে তুলেছি, তখন মরার আগে এই জট না ছাড়িয়ে মরছি না।
দুর্বল শরীরটা টেনে তুললেন নন্দ কবিরাজ। তারপর বাড়ি ফিরে একটা বলকারক পাঁচন তৈরি করে খেয়ে নিলেন। পাঁচনের গুণেই হোক, বা তীব্র অনুতাপের দরুনই হোক তাঁর শরীর আর মনের দুর্বলতা কেটে যাচ্ছিল ধীরে-ধীরে। চোখ দুটো জ্বালা করছিল।
হুট করে আর কিছু করে বসবেন না বলে ঠিক করলেন তিনি। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে। ভেবে তবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
দিনকয়েক যেতে-না-যেতেই খবর পাওয়া গেল, রাজ্যের গুণ্ডা বদমাশ, চোর-ডাকাত সব গিয়ে দিনুরাজার আস্তানায় জুটেছে। মোটা নজরানা দিয়ে তারা বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। গাঁয়ের মেলা লোকও রোজ নজরানা নিয়ে দিনুরাজাকে সেলাম ঠুকে আসছে। তাদের নামধাম সব টুকে নেওয়া হয়েছে একটা জাবদা খাতায়। যাদের নাম উঠছে, দিনুরাজা তাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছে। রাজবাড়িও প্রায় শেষ হয়ে এল। হাতের কেরামতিতে ধাঁধাঁ করে বাড়ি উঠে গেছে। গম্বুজ বসালেই হয়। হস্তশিল্পী গৌরহরিকে মন্ত্রী করা হয়েছে। ভীম দাস হয়েছে সেনাপতি। জটেশ্বরকে দেওয়া হয়েছে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের ভার।
একদিন সকালে হন্তদন্ত হয়ে এসে সদাশিব দারোগা কবিরাজমশাইকে জিজ্ঞেস করল, “নন্দবাবু, ‘দৌবারিক’ কথাটার মানে কী বলুন তো?”
“দৌবারিক কথাটার মানে? কেন বলুন তো?”
“আজ্ঞে, বড্ড ঠেকায় পড়ে গেছি। দিনুরাজা আমাকে তাঁর প্রধান দৌবারিক করতে চেয়ে একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। আমিও রাজি হয়ে গেছি। কিন্তু মুশকিল হল, দৌবারিক কাকে বলে সেটাই জানি না।”