হাতটা চলে গেল। আধঘণ্টা পরে কলসি নিয়ে ফিরে এল। আহ্লাদে দিনুর চোখে জল এসে গেল। মোহরগুলো ঢেলে গুনে দেখল সে। প্রায় দুই হাজার মোহর। বিরাট ব্যাপার। তবু এও কিছু নয়। এ তো সবে নেমন্তন্ন বাড়িতে পাতে নুন পড়ার মতো। আসল ভোজ এখনও বিস্তর বাকি।
ঝিকু ফিরে এসে মোহর দেখে মুছা যায় আর কি! তোতলাতে তোতলাতে বলল, “এই ভাঙা বাড়িতে মোহর?’ ডাকাত পড়বে যে!”
দিনু বিজ্ঞের হাসি হেসে বলল, “আসুক ডাকাত, আসুক চোর, চিন্তার কিছুই নাই রে মোর। ভয় পাসনে।”
ঝিকুকে ভয় পেতে নিষেধ করলেও, দিনুর মন থেকে একটা ভয়ের ভাব যাচ্ছে না। শশীকতা এখনও বেঁচে আছেন। শশীকতার বেঁচে থাকাটাই দুশ্চিন্তার কারণ। পথের কাঁটা। শশীকতা যদি তেড়ে ফুড়ে ওঠেন তা হলে কোন কলকাঠি নেড়ে ফের হাতটাকে বশ করে ফেলবেন, তার ঠিক কী?”
খুনখারাপি দিনু করতে চায় না বটে, কিন্তু পথ নিষ্কণ্টক করতে গেলে দু-চারটে লাশ ফেলতেই হয়। উপায় কী? অনেক ভেবেচিন্তে সে মধ্যরাতে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল। হাতটাকে বলল, “বাপু হে, একটু সহজ কাজই দিচ্ছি। আজ রাতেই শশী গাঙ্গুলিকে খুন করে আসতে হবে। কাজ শক্ত নয়, কারণ তাঁর প্রাণটি গলার কাছে এসে আটকে আছে। কষ্টও পাচ্ছেন। তা, তুমি বাপু ওই গলাটিই বেশ শক্ত করে চেপে ধরবে। প্রাণটি বেরিয়ে গেলে তবে ছাড়বে। আর শোনো, শশীকতার গলায় কালো সুতোয় বাঁধা একটু ধুকধুকি আছে, হাতে আছে বগলামুখী কবচ। তাকে যে খুন করতে পেরেছ তার প্রমাণ হিসেবে ও দুটো নিয়ে এসো।”
হাত চলে গেল। ঘণ্টাখানেক পরে কবচ আর ধুকধুকি নিয়ে। ফিরে এল।
দিনুর মনটা একটু খারাপ হল। একসময়ে শশীকতার নুন খেয়েছে। তবে ব্যাপারটা গায়ে মাখল না। এরকম আরও কত জনাকে নিকেশ করতে হবে, কে জানে! রাজা হওয়ার পথে বাগড়া দেওয়ার লোকের কী অভাব?
সকালেই দিনু বাড়িটা মেরামত করার জন্য মিস্তিরি লাগিয়ে দিল। কার বাড়ি, কী বৃত্তান্ত কিছুই জানা নেই। বাড়ি তৈরি হলেই হয়তো ওয়ারিশন এসে হাজির হয়ে বাড়ি দাবি করে বসবে। তবে চিন্তা নেই, দাবি করলে তারও ব্যবস্থা হয়ে যাবে। হাত যখন হাতে আছে, তখন চিন্তা কী?
ঝিকু সকালে কোথায় বেরিয়েছিল, ফিরে এসে খুব উত্তেজিত হয়ে বলল, “ও দিনুদাদা, কুঞ্জপুকুরে খুব কান্নাকাটি পড়ে গেছে। ভোররাতে শশীকতা মারা গেছেন।”
“বলিস কী?”
“মা কালীর দিব্যি। গাঁ সুষ্ঠু লোক কাঁদছে আর বলছে, এবার গাঁয়ের বাস তুলে দিতে হবে।”
দিনু একটু হেসে বলল, “না, না, কারও ভয় নেই। যদি দিনু রাজাকে ঠিকমতো খাজনা দেয় এবং মেনে চলে, তা হলে কারও কোনও ভয় নেই। ভীম দাস, গৌরহরি, জটেশ্বর, সবাইকে আমি ঢিট করে দেব।”
“বটে!”
“তবে আর বলছি কী? যা, গিয়ে কুঞ্জপুকুরে কথাটা প্রচার করে আয়।”
ঝিকু রওনা হয়ে পড়ছিল। দিনু ডেকে বলল, “ওরে, ওরকম ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকে গেলে তোর কথার দামই কেউ দেবে না। দাঁড়া, ভাল পোশাক পরে যা। আর কী বলছি, তাও শিখে যা।”
“ভাল পোশাক পাব কোথায়?”
ভাল পোশাকের অবশ্য অভাব হল না। দিনুর ফরমাশে হাত গিয়ে কোথা থেকে ঝলমলে পোশাক নিয়ে এল। একটা ঘোড়াও জোগাড় হয়ে গেল। মায় কোমরে একটা তলোয়ার অবধি।
ঝিকু গিয়ে যখন কুঞ্জপুকুরে ঘোড়া দাবড়িয়ে ঢুকল, তখন লোকে অবাক, জরির পোশাক পরা ঘোড়সওয়ার তারা কখনও দেখেনি।
ঝিকু ঘোড়ায় বসেই চিঙ্কর করে ঘোষণা করল, “আমি দিনুরাজার কোটাল ঝিকু। আপনারা মন দিয়ে শুনুন! এখন থেকে যাঁরা দিনুরাজাকে নিয়মিত খাজনা দেবেন, তাঁদের কোনও ক্ষতি হবে না। দিনুরাজা তাঁদের রক্ষা করবেন। কুঞ্জপুকুর এবং আশপাশের দশখানা গাঁ নিয়ে আপাতত দিনুরাজা তাঁর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। রাজ্যের পরিধি আরও বাড়বে। রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে। কিন্তু বেয়াদবি করলে বিপদ হবে, আগেই বলে দিচ্ছি।”
লোকে এই ঘোষণা শুনে থ’ হয়ে গেল।
শুধু অবাক হলেন না কবরেজমশাই। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। দিনু বিশ্বের যে হাতটাকে কাজে লাগিয়ে ফেলেছে, তাতে আর সন্দেহ নেই। এর জন্য তিনিও পাপের ভাগী।
ঝিকু ঘোষণা করল, “কুঞ্জপুকুরের উত্তর দিকে এক মাইল দূরে দিনুরাজার প্রাসাদ তৈরি হচ্ছে। রাজামশাই এখন সেখানেই তাঁবুতে অবস্থান করছেন। যাঁরা দেখা করতে যাবেন, পাঁচ টাকা নজরানা নিয়ে যাবেন। আর কয়েকদিন বাদেই তাঁর দরবারও শুরু হবে। মামলা-মকদ্দমার বিচার এখন থেকে তিনিই করবেন।”
৫. শশীবাবু মারা গেছেন
কবরেজমশাই সকালেই খবর পেলেন, শশীবাবু মারা গেছেন। প্রায় ছুটতে ছুটতে গিয়ে যখন শশীবাবুর বাড়িতে হাজির হলেন, তখন ভিড় জমে গেছে বাইরে। কান্নাকাটি পড়ে গেছে। নন্দ কবিরাজের বুকের ভেতরটা হাহাকারে ভরে যাচ্ছিল। নিমিত্তের ভাগী কি তিনিই হলেন?
ভিড় ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখেন, গাঁয়ের মাতব্বররা সব শোকাতুর মুখে দাঁড়িয়ে। শুভ্র শয্যায় শশীবাবু শয়ান। মুখটা একটু কাত হয়ে আছে। একজন মস্ত চেহারার রক্তাম্বর পরা, জটাজুটধারী তান্ত্রিক মাথার কাছে বসা। তাঁর পায়ের কাছে পড়ে কাঁদছে ক্ষান্তমণি আর বলছে, “আমার বাবাকে বাঁচিয়ে দিন … বাঁচিয়ে দিন।”
তান্ত্রিক দুঃখের গলায় বললেন, “তাই কি হয় মা, প্রাণপাখি একবার উড়ে গেলে আর কি খাঁচায় ফেরে। তবে বড় অকালেই চলে গেল শশী। এইটুকু দেখেছিলুম। কতই বা বয়স তখন, সাত-টাত হবে। ওর উপনয়নে আমিই তো ছিলাম আচার্যগুরু। সাবিত্রীমন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলাম। এই একশো নব্বই বছর বয়সে আমি তো দিব্যি হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছি, পাহাড়ে উঠছি, কাঠ কাটছি, দিনে দশ বারো ক্রোশ হাঁটছি। আর দ্যাখো, কচি বয়সেই শশীটা চলে গেল। তাও স্বাভাবিক মৃত্যু হলে দুঃখের তেমন কিছু ছিল, কিন্তু মরলও তো অপঘাতে কিনা, গতি কী হবে কে জানে!”