ডাইনি-পুকুরের ধারে অন্ধকারে একটা ঝোঁপের আড়ালে ঝিকু অপেক্ষা করছিল। দিনুকে দেখে বেরিয়ে এসে সঙ্গ ধরে বলল, “পেলে জিনিসটা?”
“দেখ ঝিকু, সব ব্যাপারে নাক গলানোটা আমি পছন্দ করি না। তুই আমার কোটাল, কোটাল থাকবে কোটালের মতো। রাজা-গজার সঙ্গে সমানে-সমানে অত মাখামাখি কিসের! ইয়ার-বন্ধু নাকি?”
‘ঝিকু একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “রাগ করো কেন দাদা? যখন রাজা হবে, তখন তো দোবেলা সেলাম ঠুকতেই হবে। এখনও
তো হওনি, তাই ক’দিন একটু মেলামেশা করে নিচ্ছি।”
“ট্রেনিং থাকা ভাল। নইলে বেয়াদবি অভ্যেস হয়ে গেলে তখনও হয়তো ফাজলামি করে বসবি।”
জিভ কেটে ঝিকু বলল, “না, না। সেটা খুব খেয়াল থাকবে।”
দু’জনে নীরবে হাঁটল কিছুক্ষণ, তারপর ঝিকু হঠাৎ বলল, “যদি অপরাধ না নাও, তা হলে একটা কথা বলি।”
“কী কথা?”
“বলছিলাম কি, তুমি দরটা বড্ড কম নিলে। অত সস্তায় বাচ্চাটাকে বিক্রি করা তোমার ঠিক হয়নি। মাত্র দুশো টাকা অমন ফুটফুটে ছেলের দাম হয়? হেসেখেলে দু হাজার তো হবেই।”
গম্ভীর হয়ে দিনু বলল, “এইজন্যই তো আমি রাজা, আর তুই কোটাল। সংস্কৃতে একটা কথা আছে জানিস? বিপদে পড়লে পণ্ডিতেরা অর্ধেক ত্যাগ করে। একটা ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে এখন যদি আমি দোরে-দোরে ঘুরে দর বাড়ানোর চেষ্টা করি, তা হলে
আমার তখন ঘাড় থেকে জিনিসটা নামানোর দরকার ছিল, তাই বেদেদের কাছে বেচে দিলাম। তারা গতকালই এ-তল্লাট ছেড়ে চলে গেছে।”
কুঞ্জপুকুর থেকে মাইলটাক দূরে জঙ্গলের মধ্যে একটা পোড়া বাড়ি। ধ্বংসস্তূপই বলা যায়। সাপখোপের আস্তানা। ওই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই দু’খানা ঘর আজও পড়ো-পড়ো হয়ে কোনওক্রমে টিকে আছে। এখানেই দিনুর আস্তানা। কাছাকাছি লোকবসতি নেই।
ঝিকু বলল, “দেখ দিনুদাদা, তোমার নজরটা কিন্তু তেমন উঁচু নয়। তুমি বলছ, রাজা হলে এই পোড়ো বাড়িটাকেই রাজবাড়ি করবে, এটা আমার মোটেই ভাল ঠেকছে না।”
“তুই বোকা। এই বাড়িটা এমন সুন্দর করে আবার তৈরি করব যে, দেখে লোকের তাক লেগে যাবে। কিন্তু আজ আর কথা নয়। তুই ঘুমোগে, আজ রাতে আমার জরুরি কাজ আছে।”
ঝিকু পাশের ঘরে ঘুমোতে গেল। কিছুক্ষণ পর যখন তার নাক ডাকতে শুরু করল, তখন দিনু হাতখানা চাঁদরের তলা থেকে বের করে মোমবাতির আলোয় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল ভাল করে। এটা আসল হাতটাই বটে! সন্দেহের কোনও কারণ নেই।
দিনু শতরঞ্চির ওপর বসে হাতটা মুঠো করে ঘরে ধ্যানস্থ হল, আন উনো এফেন… আন উনো এফেম… আন উনো এফেনড্রাম… না, হচ্ছে না। আন উনো এটেনখাম… নাঃ, ওটাও নয়….
ধৈর্যশীল দিনু সারারাত ধরে চেষ্টা করতে লাগল। শশীবুড়ো অনেকটা এরকমই কী যে বলত, আন উনো. আন উনো এফ এন ডো… আন উনো….
প্রায় ভোরের দিকে দিনু ঢুলতে-ঢুলতে হঠাৎ চমকে উঠল। কী হল? হাতটা কি একটু নড়ে উঠল নাকি? নাকি মনের ভুল? ঘুম ছুটে গেল দিনুর। হাতটা চেপে ধরে সে মনে করার চেষ্টা করতে লাগল। আন উনো এফ এন ডার… আন উনো এফ এন ড্রো…
দিনুকে প্রায় চমকে দিয়ে হঠাৎ তার হাতের মধ্যে হাতটা নেতানো ভাব থেকে চড়াক করে লাফিয়ে উঠল। পাঁচটা আঙুল টান-টান হয়ে উঠল প্রথমে। তারপর আঙুলগুলো বারবার মুঠো হয়ে খুলে যেতে লাগল। জেগেছে! হাতটা জেগেছে!
দিনু প্রথমটায় হোঃ হোঃ করে খানিকটা হেসে নিল। সারা জীবনের যত স্বাদ-আহ্লাদ সব এবার পূর্ণ হওয়ার মুখে। আর চিন্তা নেই। এখন সে সত্যিই রাজা।
হাতটা শূন্যে উঠে গেল। তারপর ছটফট করতে লাগল। দিনু হাতটার দিকে চেয়ে বলল, “এবার তোর আসল খেল শুরু। শশীকতা তোকে কাজেই লাগাতে পারেনি। আহাম্মকের হাতে পড়ে তোর বড্ড হেনস্থাই হচ্ছিল রে! এবার আসল লোকের হাতে এসে পড়েছিস। যা বাবা, প্রথমে একটু হালকা কাজ দিয়েই শুরু কর। হাটগঞ্জের মতি ময়রার দোকানে খুব ভোরবেলা জিলিপি ভাজে, আর হিংয়ের কচুরি। এক চাঙারি জিলিপি আর এক চ্যাঙাড়ি কচুরি নিয়ে আয় তো।”
হাতটা শোঁ করে বেরিয়ে গেল। তারপর পাঁচ মিনিট যেতে-না-যেতেই পাঁচ আঙুলের ফাঁসে দুটো চ্যাঙাড়ি ঝুলিয়ে ফিরে এল।
“ও ঝিকু, ওঠ, ওঠ। দেখ এসে কাণ্ড! মার দিয়া কেল্লা।”
হাতটা শূন্যে ভাসছিল। দিনু সেটিকে ধরে কম্বলের নিচে চাপা দিয়ে রেখে বলল, “একটু জিরিয়ে নাও বাবা। এর পর মেলা মেহনত আছে।”
ঝিকু ঘুম থেকে উঠে জিলিপি আর কচুরির আয়োজন দেখে অবাক! “এ কী কাণ্ড গো দিনুদাদা?”
“কেল্লা মেরে দিয়েছি। কোটালের চাকরি তোর পাকা। এখন আয়, জিলিপি আর কচুরি খা।”
ঝিকুর চোখ চকচক করতে লাগল। বলল, “সত্যি? তা বেতনটা কত দেবে বলো তো?”
“আহা, আগেই বেতনের কথা তুলিস কেন? আগে কাজকর্ম দেখি, তারপর ঠিক হবে। ধর গে, মাসে দু-তিন হাজার তো হবেই।”
“বটে!”
“তার ওপর উপরি আছে। সেও কম নয়। তার ওপর কোটালের কত বড় সম্মান।”
“কিন্তু কোটাল কাকে বলে তাই তো এখনও জানা হল না!”
“জানা আর শক্ত কী? দু’দিন রোস, তারপর সভাপণ্ডিতের কাছে জেনে নিবি।”
“সভাপণ্ডিত! সে আবার কে?”
“রাজাদের ওসব থাকে। তারা তো লেখাপড়া করে না, তাদের হয়ে ওই পণ্ডিতেরা লেখাপড়া করে। রাজার যখন যা জানার, তা ওদের কাছ থেকে জেনে নেয়।”
“এ তো খুব ভাল ব্যবস্থা গো দিনুদাদা।”
দিনের বেলা হাতটাকে বেশি ব্যবহার করাটা যুক্তিযুক্ত মনে হল না দিনুর। পাঁচজনের চোখে পড়ক এটা সে চায় না। সারাটা দিন সে তাই চুপচাপ রইল। সন্ধের পর ঝিকুকে একটা কাজের ছুতোয় বাইরে পাঠিয়ে সে হাতটাকে বের করে বলল, “শোনো বাপু, আপাতত শক্ত কাজ দিচ্ছি না। আজ বউনির দিন। আমার কাছে খবর আছে, সুলতানগঞ্জের জমিদার নব মল্লিকের পাতালঘরে এক কলসি মোহর আছে। চট করে গিয়ে কলসিটা নিয়ে এসো তো।”