ক্রমে রাত হল। চারদিক নিশুতি হয়ে গেল। এমন সময় জানলায় ঠকঠক শুনে, গিয়ে পাল্লাটা খুললেন।
“কে?”
“অধমের নাম দিনু বিশ্বেস। হস্তান্তরটা হয়ে যাক।”
“দিচ্ছি। কিন্তু আগে বলো, হাতটা নিয়ে তুমি কী করবে?”
দিনু একটু হেসে বলল, “আজ্ঞে, হাত জোগাবে ভাত।”
“তার মানে?”
“গরিব মানুষদের তো ওই একটাই চিন্তা, না কি বলুন। হাতটি পেলে আমার ভাতের জোগাড় হবে।”
“তুমি কি এই হাত কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা জানো?”
“আজ্ঞে, শিখে নেব।”
“শিখে নেবে? শশীবাবু কাউকে তো বিদ্যেটা শেখাননি।”
“আজ্ঞে না। তবু চেষ্টা করতে দোষ কী?”
“তুমি পাজি লোক। যদি বিদ্যেটা ধরে ফেলো, তা হলে এই হাতকে তো পাপের কাজেই লাগাবে।”
“কী বলেন কবরেজমশাই!”
“ভুল বলছি?”
দিনু খুবই লাজুক গলায় বলল, “যতসব চোর-ডাকাতদের দেখেন, তারা হল ভারি নিচু নজরের মানুষ। আমি আজ্ঞে তাদের মতো নই। হাতটি কাজে লাগাতে পারলে এই অধম দিনু বিশ্বেস দেখবেন, গাঁয়ের সব দুঃখ ঘুচিয়ে দেবে। শশীকতা হাতখানা পেয়ে এতকাল চোর-ডাকাত ঠ্যাঙানো আর ম্যাজিক দেখানো ছাড়া আর কী করেছে বলুন তো! মানুষের দুঃখ ঘুচিয়েছে? হাতটাকে ঠিকমতো কাজে লাগালে কত কী করা যেত! একটা পুকুর খোঁড়া যেত, তাতে গাঁয়ের জলকষ্ট দূর হত। টাকা-পয়সা রোজগারের কাজে হাতটাকে লাগালে এ-গাঁয়ে আজ একটাও গরিব থাকত না। তারপর ধরুন, এই হাতটাকে লাগিয়ে রাস্তাঘাট তৈরি, হাসপাতালের ব্যবস্থা, কত কী কার ছিল! আমি বলি, শশীকতার হাতে পড়েই হাতটার এই দুরবস্থা! এবার উপযুক্ত হাতে পড়ে হাতটা কী খেল দেখায় তাই দেখবেন?”
“তা বাপু, তুমি গতকাল আমাকে মন্ত্রী হওয়ার কথা বলেছিলে। কথাটা একটু খোলসা করে বলবে?”
দিনু খুবই লজ্জিত গলায় বলল, “গরিবের আস্পদ্দাটা যদি না ধরেন তো বলি, আমি এই কুঞ্জপুকুর আর তার সঙ্গে দশ বারোটা গাঁ নিয়ে একটা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি। একেবারে রামরাজ্য যাকে বলে। কোথাও কোনও অশান্তি-ঝঞ্ঝাট থাকবে না, কোনও অবিচার-অনাচার খুঁজেও পাবেন না। সুখ একেবারে উপচে পড়বে। তা সেই কথা ভেবেই মন্ত্রী হওয়ার কথাটা বলা!”
“তা তুমিই রাজা হবে নাকি?”
একটু আমতা-আমতা করে দিনু বলল, “হওয়ার ইচ্ছে তেমন ছিল না, বুঝলেন! রাজা হওয়ার অনেক ঝকমারি। চারদিক সামলে চলতে গেলে নাওয়া-খাওয়া অবধি ভুলতে হয়। কিন্তু পাঁচজনে ধরে পড়েছে, তাই অনিচ্ছের সঙ্গেই হতে হচ্ছে আজ্ঞে। হস্তান্তরটা কি এইবেলা সেরে ফেলবেন? চারদিকে রাত-পাহারা বসেছে, বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে ভরসা হয় না। কাদের যেন পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি।”
“আগে বলো, আমার নাতি কেমন আছে?”
“আজ্ঞে, ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে। তবু বলি, সে এত ফুর্তিতে আছে যে, বাড়ি ফেরার মোটেই ইচ্ছে নেই। আমারও তাকে বড্ড পছন্দ। আহা, যেন দেবশিশু। আমাকে ‘কাকা বলে ডাকছে।”
“সে কি বাড়ির জন্য কান্নাকাটি করছে না?”
“কান্না! কী যে বলেন কবরেজমশাই! আমরা যত তাকে দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি। কান্না তার ত্রিসীমানায় নেই।”
“তুমি কি জানো যে, তুমি অতি পাষণ্ড?”
“লজ্জা দেবেন না কবরেজমশাই। ভাল পাষণ্ড হতে হলেও এলেম চাই, বুকের জোর চাই। আমি বড্ড নরম মনের মানুষ। পাষণ্ড হতে পারলে কষে পায়ের ওপর পা তুলে জীবন কাটাতে পারতুম। তা আর দেরি করাটা কিন্তু ঠিক হবে না। একটু হাত চালিয়ে হাতটা আমার হাতে হস্তান্তর করে ফেলুন। হাতটা বেহাত হয়ে গেলে আমাদের আর কিছু করার হাত থাকবে না। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়তে হবে। এই হাত নিয়ে কারও সঙ্গে হাতাহাতি হোক তা আমি মোটেই চাই না।”
কবরেজমশাই অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মনে আলমারি খুলে হাতটা বের করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। একটা মস্ত বড় বিশ্বাসঘাতকতা হয়ে যাচ্ছে। পাপও হচ্ছে। কিন্তু বাবলুকে বাঁচাতে হলে এ ছাড়া আর উপায়ই বা কী? এর পরও আরও পাপ কাজ করতে হবে। শশীবাবুকে সঠিক ওষুধ না দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া! নন্দ কবিরাজের বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। নরকে পচতে হবে। নরক জায়গাটা কতদূর খারাপ, কে জানে!
জানলা দিয়ে হাতটা বাড়াতেই দিনু খপ করে সেটা প্রায় কেড়ে নিয়ে নিল। অমায়িক গলায় বলল, “মন্ত্রী আপনিই হচ্ছেন ধরে নিন। আরও দু-চারজন উমেদার আছে বটে, কিন্তু আপনার দাবিই জোরালো।”
কবরেজমশাই বললেন, “রক্ষে করো বাপু, আমার মন্ত্রী হওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই।”
“আজ্ঞে, আপনি অনেংটা আমারই মতো। কোনও কিছুতেই লোভ নেই। তবে পরের যদি ভাল হয়, দেশের যদি উপকার হয়, তা হলে নাহয় অনিচ্ছের সঙ্গেই হলেন। যেমন আমি। পাঁচজনে ধরে না পড়লে আমিই কি রাজা হতে চেয়েছিলুম! যাক গে, একটু ভেবে দেখবেন প্রস্তাবটা।”
“তোমার সঙ্গে কথা বললেও পাপ হয়, এখন বিদেয় হও।”
“যে আজ্ঞে। আপনার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দু দণ্ড কথা বললেও বিস্তর জ্ঞান হয় মশাই। পেন্নাম হই।”
বেঁটে ছায়ামূর্তিটা জানলা থেকে মিলিয়ে যেতেই কবরেজমশাই জানলা বন্ধ করে নিজের চেয়ারখানায় এসে চুপচাপ বসে রইলেন। বুকটা বড় ধুকপুক করছে। সকালবেলায় দৃশ্যটা কি ভুল দেখলেন? শশীখুড়ো যে ঘাড় তুলে মুখ ফিরিয়ে চেয়েছিলেন–সেটা কি একান্তই মনগড়া? মনগড়া হলেও তাঁর কেমন যেন গা-ছমছম করছে। ভয় হচ্ছে। হাতখানা বেহাত হয়ে গেল, সেটাও একটা মস্ত বিশ্বাসঘাতকতা হল। বুড়ো বয়সে এসে এ কী চক্করে পড়ে গেলেন তিনি?