মহিম ঘোষ বললেন, “আমারও ওই কথা। এই বলে রাখছি, একটা ব্যবস্থা না হলে কুঞ্জপুকুরে আর গেরস্তর বাস থাকবে না।”
সবাই কথা থামিয়ে নন্দ কবিরাজের দিকে উদ্বিগ্ন মুখে তাকাল। হরিবল্লভ বললেন, “ও নন্দ, শশীবাবুকে এবার যদি চাঙ্গা করে তুলতে না পারে, তা হলে সমূহ সর্বনাশ। গুণ্ডা-বদমাশরা যে একেবারে কেত্তন করতে শুরু করল!”
নন্দ কবিরাজ গম্ভীর মুখে বললেন, “দেখছি, কী করা যায়!” শশীবাবুর ঘরে ঢুকে নন্দ কবিরাজ থ’ হয়ে গেলেন। শশী গাঙ্গুলির খাটের পাশেই একটা টেবিলে হাটা রাখা ছিল, এখন সেটা নেই।
ভেতরে-ভেতরে ঘাবড়ে গেলেও মুখটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে তিনি শশীবাবুর নাড়ি ধরে বসে রইলেন। নাড়ি রোজকার মতোই ক্ষীণ। শশীবাবু সাড়া দিচ্ছেন না।
একটা পাঁচন খাইয়ে দিয়ে নন্দ কবিরাজ ক্ষান্তমণিকে জিজ্ঞেস করলেন, “তা হাঁ গো ক্ষান্তমণি, বলি শশীবাবুর হাতটা কই? সেটা তো দেখছি না? চুরি হয়ে যায়নি তো?”
“না কবরেজমশাই, সেটা আমি লোহার আলমারিতে তুলে রেখেছি। আমাদের কাজের মেয়ে, রাসু কোত্থেকে শুনে এসেছে, আজ নাকি হাতটা চুরি করতে আসবে ভীম দাস আর গৌরহরি। তাই তুলে রেখেছি।”
“তা ভালই করেছ। কোন আলমারিতে রাখলে?”
“ওই তো, বাবার মাথার কাছেই আলমারি।”
“চাবিটা কোথায় রেখেছ?”
“এই তো আমার আঁচলে”, বলে ক্ষান্তমণি আঁচলে বাঁধা চাবিটা দেখাল।
নন্দ কবিরাজ হাঁ-হাঁ করে উঠলেন, “না, না, কাজটা ঠিক হচ্ছে, চাবি তোমার কাছে রাখলে তোমারই বিপদ। ভীম দাস এলে কি সহজে ছাড়বে? গলায় খাঁড়া চেপে ধরে চাবি কেড়ে নেবে। তার চেয়ে চাবিটা বরং আর কারও কাছে পাচার করে দাও। বাড়িতে রেখো না।”
“তার দরকার নেই কবরেজমশাই, আজ সবাই আমাদের বাড়ি পাহারা দেবে। সদাশিব দারোগা নিজেও থাকবে।”
নন্দ কবিরাজ একটু হাসলেন, “ওদের তো চেনো না ক্ষান্তমণি, তাই বলছ। গাঁয়ের লোক আর সদাশিব মিলে কিছুই করতে পারবে না। তারা সব বোমা, বন্দুক নিয়ে আসবে। গাঁয়ের ক’টা লোকের ওসব আছে? দিনু দাসের আর হরিবল্লভ রায়ের দু’ খানা গাদা বন্দুক ছাড়া আর কী আছে বলল! আর সদাশিব! ছছাঃ। তার যা অবস্থা, তাতে আজকাল ইঁদুরও তাকে ভয় পায় না।”
ক্ষান্তমণি সভয়ে বলল, “ তা হলে কী হবে কবরেজমশাই?”
“হাতটাকে যেমন করেই হোক রক্ষা করতে হবে। চাবিটা অন্য জায়গায় থাকলে ডাকাতরা চট করে নিয়ে যেতে পারবে না। লোহার আলমারি ভাঙতে হবে। কিন্তু এ তো বেশ মজবুত আলমারি দেখছি। ভাঙা সহজ কাজ নয়।
“চাবিটা তা হলে আপনিই নিয়ে যান কবরেজমশাই।”
“না, না, আমি কেন?” বলে নন্দ কবিরাজ একটু আপত্তি প্রকাশ করলেন। তারপর যেন অনিচ্ছের সঙ্গেই বললেন, “আচ্ছা, দাও। কাউকে-না কাউকে তো দায়িত্ব নিতেই হবে।”
চাবিটা নিতে গিয়ে হাতটা থরথর করে কাঁপছিল তাঁর। গলা শুকিয়ে আসছে। বললেন, “ক্ষান্তমণি, আমার শরীরটা ভাল নেই। নাতির জন্য ভেবে-ভেবে মাথাটাই খারাপ হওয়ার জোগাড়! আমাকে পাতিলেবুর রস দিয়ে এক গেলাস জল দাও
“এই দিই।” বলে ক্ষান্তমণি প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল। নন্দ কবিরাজ তাড়াতাড়ি উঠে আলমারিটা খুলে ফেললেন। দিনের বেলা, চারদিকে মানুষজন। যে-কেউ দেখে ফেলতে পারে। হাতটাও বড্ড কাঁপছে। কিন্তু উপায়ই বা কী? একাজটা না করলে তাঁর নাতির প্রাণরক্ষা হয় না। আলমারির ওপর-তাকে হাতটা রাখা ছিল। চট করে বের করে এনে চাঁদরের তলায় লুকিয়ে ফেললেন, তিনি। তারপর আলমারিটা বন্ধ করে যেই ফিরেছেন অমনই তাঁর সর্বাঙ্গে যেন একটা বরফের হিমশীতল স্পর্শ খেলে গেল। কেননা তাঁর মনে হল, শশীবাবু যেন এতক্ষণ ঘাড় তুলে তাঁকে দেখছিলেন। তিনি ফিরে তাকানো-মাত্র শশীবাবু যেন মাথাটা বালিশে ফেলে চোখ বুজে ফেললেন।
নন্দ কবিরাজের হাত-পা এত কাঁপতে লাগল যে, তাঁর মনে হল, এবার মূছ যাবেন। হাতটাও তাঁর শিথিল মুঠো থেকে আর একটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দম নিলেন তিনি, যা দেখেছেন তা কি ভুল দেখেছেন? দেখেছেন বলাও ভুল। চোখের কোণ দিয়ে যেন আবছা মনে হল, শশীবাবু তাঁকে দেখছেন। ভুলও হতে পারে। মানুষ যখন আতঙ্কে থাকে, তখন কত ভুলভাল অনুমান করে।
সাহসে ভর করে তিনি আবার শশীবাবুর কাছে এসে বসলেন। নাড়িটা আবার পরীক্ষা করলেন, এখনও নাড়ি ক্ষীণ। তাঁর অভিজ্ঞতা বলে, এই অবস্থায় রোগীর বাহ্যচৈতন্য থাকার কথা নয়। তা হলে ভুলই দেখেছেন।
ক্ষান্তমণি যখন লেবুর জল এনে দিল, তখন বাস্তবিকই তাঁর শরীর খারাপ লাগছে, তেষ্টায় বুকটা কাঠ। ঢকঢক করে জলটা খেয়ে নিয়ে উঠে পড়লেন।
বাড়িতে ফিরেই নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে–হাতটা আর চাবিটা নিজের লোহার আলমারিতে তুলে রেখে চাবি ট্যাঁকে খুঁজে ফেললেন। কাজটা বেশ বুদ্ধির সঙ্গেই করেছেন। হাতটা যে চুরি গেছে, তা ক্ষান্তমণি বুঝতেই পারবে না কিছুদিন। চাবি তাঁর কাছে, সুতরাং আলমারি খোলার উপায় নেই।
যারা শশীবাবুর জন্য ওষুধের গাছগাছড়া আনতে গিয়েছিল, তারা সবাই এসে গাছগাছড়া সবই দিয়ে গেছে। নন্দ কবিরাজ সারাদিন ধরে সেইসব গাছগাছড়া সেদ্ধ করতে লাগলেন। কোনওটা রস করলেন হামানদিস্তায়। কোনওটাবা পুড়িয়ে ভস্ম করতে হল। শক্ত কাজ। তবে দুটো জিনিস ব্যবহার করলেন না। নাতির মুখ চেয়ে একাজ তাঁকে করতেই হবে।