“কী কথা দিনুদাদা?”
“আগের দিনে যত রাজারাজড়া ছিল, যত জমিদার মহাজন, সবাই ছিল আদতে ডাকাত আর লুঠেরা। দলবল আর টাকার জোরে দলবাজ সর্দাররাই রাজাগজা হয়ে বসেছিল। বুঝতে পারছিস তো? না বুঝলে বলিস, আবার বুঝিয়ে দেব।”
“দিব্যি বুঝতে পারছি।”
“তা হলে চোর-ডাকাতের সঙ্গে রাজা-মহারাজাদের আর তফাতটা রইল কী, বল! আলেকজাণ্ডার, তৈমুরলঙ, মামুদ, চেঙ্গিস খানের সঙ্গে রঘু ডাকাত বা কালু সদারের কোনও ফারাক দেখতে পাস?”
“কাদের কথা বলছ গো! গণ্ডার, লবঙ্গ, ঝিঙে কীসব বলে গেলে, এরা কারা?”
“ঐতিহাসিক লোক। তোর বুঝে কাজ নেই। এখন চুপ করে থাক। আমাকে একটা গুরুতর কথা ভাবতে হচ্ছে।”
“ভাবো দিনুদা। এই আমি চুপ মারলাম।”
দিনুকে সত্যিই ভাবতে হচ্ছে। কারণ, সে যখন শশীবাবুর বাড়িতে কাজ করত, তখন হাতের কেরামতি দেখে সে তাজ্জব হয়ে যায়। হাতখানা কীভাবে ক্রিয়া করে, সেদিকে তার খুব নজর ছিল। কিন্তু শশীকতাও সোজা লোক নন। যা করার করতেন খুব চুপিচুপি, ঘরের দরজা এঁটে।
তবে দিনু হাল ছাড়ার পাত্র নয়। দিনের পর দিন সে বন্ধ দরজায় আড়ি পাতত। দরজায় গোপনে একটা ছিদ্রও করে রেখেছিল সে। সেই ছিদ্র দিয়ে দেখারও চেষ্টা করত। অনেক দিনের চেষ্টায় সে বুঝতে পেরেছিল, হাতটাকে শক্তি সঞ্চার করার একটা মন্ত্র আছে। প্রত্যেকদিন সকালবেলায়, ব্রাহ্মমুহূর্তে হাতটাকে জাগিয়ে তুলতে হয়। না তুললে হাতটা কাজ করে না।
কিন্তু মন্ত্রটা কী, তা জানা যাবে কী করে? শশীকর্তা বন্ধ ঘরের মধ্যে ব্রাহ্মমুহূর্তে কী মন্ত্র পাঠ করেন, তা শোনার তো উপায় নেই। তবে বুদ্ধি থাকলে উপায় হয়। পাড়ার বসন্ত পাল কানে কম শোনেন। তাঁর একটা কানে শোনার যন্ত্র ছিল। স্নানের সময় সেটা খুলে রাখতে হত। দিনু একদিন ফাঁক বুঝে বসন্ত পালের বাড়ি থেকে সেটা সরিয়ে ফেলল। তারপর যন্ত্রটা কানে লাগিয়ে রোজ ব্রাহ্মমুহূর্তে গিয়ে শশীবাবুর দরজায় কান পাতত।
প্রথম কয়েকদিন তেমন সুবিধে হয়নি। তারপর ধীরে-ধীরে যন্ত্রটা কানে সেট করে গেলে একদিন শুনতে পেল, শশীবাবু মন্ত্রটা পড়লেন, “আ মরণ, ফিনাইলের ড্রাম।”
কিন্তু কথাটার তেমন মানে হয় না। ‘আ মরণ, ফিনাইলের ড্রাম’ কি কোনও মন্ত্র হতে পারে?
আর-একদিন মনে হল, আগুন ও পেত্নির ধাম’। এ কথাটারও কোনও মানে খুঁজে পেল না সে। তবে রোজ কান পাততে-পাততে একদিন মনে হল, সঠিক মন্ত্রটা হচ্ছে,’আন উনো, ফেরে…’ ব্যস, বাকিটা আর ধরতে পারেনি। পরদিনই তাকে তাড়ানো হয়। হাতটা হাতানোর ইচ্ছে ছিল। তাও হল না। কারণ শশীবাবুর কাছ থেকে বিদায় হওয়ার পর সে একটা চুরির কেসে ফেঁসে গিয়ে তিনটি বছর জেলে কয়েদ ছিল।
৪. হরিবল্লভ রায়ের বাড়িতে ডাকাত
রাত্রিবেলা হরিবল্লভ রায়ের বাড়িতে ডাকাত পড়ল। রাত বারোটা নাগাদ ভীম দাস তার দলবল নিয়ে দরজা ভেঙে যখন বাড়িতে ঢুকল, তখন তাকে দেখে সকলেই থ। গলায় গাঁদা ফুলের মালা, মাথাভর্তি আবির, কপালে সিঁদুরের টিপ। হুহুঙ্কারে চারদিক প্রকম্পিত করে লুটপাট সেরে চলে যাওয়ার সময় হরিবল্লভ রায়কে বলল, “বউনিটা সেরে গেলাম।”
মহিম ঘোষের বাড়িতে ঢুকল চোর, তাঁর বড় ছেলে জানলার শিক ভাঙার শব্দ পেয়ে উঠে টর্চ জ্বেলে দেখতে পেল, জানলায় গৌরহরি দাঁড়িয়ে।
তাকে দেখে জিভ কেটে বলল, “ইস, কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলাম বুঝি? অনেককালের অনভ্যাস তো, তাই হাতটা সড়গড় নেই। জানলার শিক কাটতে গিয়ে শব্দ করে ফেলেছি। তবে ভাববেন না, কয়েকদিন একটু প্র্যাকটিস করলেই হাত সড়গড় হয়ে যাবে। তখন গেরস্তও নিশ্চিন্তে ঘুমোবে, হস্তশিল্পীরাও নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারবে।”
হরিপদ সাহার পাশের বাড়িতেই থাকে তার ভায়রাভাই নবকুমার দাস। দুই ভায়রাভাইয়ে বহুকালের ঝগড়া। হরিপদর জমি নাকি খানিকটা বেদখল করে বসে আছে নবকুমার। নিশুতরাতে জটেশ্বর গিয়ে হরিপদর জানলায় হানা দিল। বলল, “বউনিতে রেট কম করে দিয়েছি। দুটি হাজার টাকা ফেলুন, আপনার ভায়রার কাটামুণ্ডু আপনার সদর দরজায় রেখে যাব।” শুনে হরিপদ মূর্ছা যায় আর কি!
গাঁয়ে এইসব সাঙ্ঘাতিক-সাঙ্ঘাতিক ঘটনা ঘটায় সকলেই উদ্বিগ্ন। সকালবেলাতেই সবাই শুকনো মুখে শশী গাঙ্গুলির বাড়িতে এসে জড়ো হয়েছেন। ক্ষীণ আশা, যদি শশীবাবু গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন, তা হলে এখনও কুঞ্জপুকুরের ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার নয়।
নন্দ কবিরাজ সারারাত ঘুমোননি। বসে বসে ভেবেছেন। বাড়িতে সারারাত বাবলুর জন্য কান্নাকাটি চলেছে। সকালবেলায় মনঃস্থির করে ফেলেছেন তিনি। হাতটা সরিয়েই ফেলবেন। পাপ যা হওয়ার হবে, কিন্তু নাতিটা তো রক্ষা পাবে। আর শশীবাবুর জন্য ওষুধটাও তিনি একটু হাতটান করেই করবেন। দুটো-একটা গাছগাছড়া নাহয় বাদই দেবেন। মনটা অবশ্য সায় দিচ্ছে না, কিন্তু মায়ায় বড় দুর্বল হয়ে পড়েছেন।
চুরিটুরি জীবনে করেননি। তাঁর হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপছিল। “দুর্গা” বলে সকালেই বেরিয়ে পড়লেন তিনি। কিন্তু শশীবাবুর বাড়িতে এসে দেখেন, সাতসকালেই গাঁয়ের মাতব্বররা এসে জুটে গেছেন সেখানে। রাতে যেসব রোমহর্ষক ঘটনা ঘটে গেছে, তাই নিয়েই তুমুল আলোচনা হচ্ছে। হরিবল্লভ রায় বলছিলেন, এর একটা বিহিত না করতে পারলে আমাকে সাত পুরুষের ভিটে ছাড়তে হবে।