“তবু বলো।”
“যে আজ্ঞে। আপনি বয়স্ক, শ্রদ্ধেয় মানুষ। ভগবানের দিব্যি করেই বলছি, হাতে হাত, শশী কাত, ফেরত নাত।”
“তার মানে কী?”
“মানে খুব সোজা। হাতে হাত, মানে শশীবাবুর হাতটি যখন আমার হাতে আসবে। শশী কাত, মানে শশীবাবু যখন মহাপ্রয়াণ করবেন। আর ফেরত নাত, মানে আপনার নাতি তখনই ফেরত আসবে। জলবৎ-তরলং।”
নন্দ কবিরাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “কাল রাতে এসো।”
“আপনার মতো বিচক্ষণ লোক দুটি দেখিনি মশাই। যত দেখছি ততই শ্রদ্ধা হচ্ছে। আপনার মতো মানুষের সঙ্গে কাজকারবার করে সুখ আছে। তা ইয়ে, কবরেজমশাই, আমি এই আপনার মতোই একজন বিচক্ষণ মন্ত্রী খুঁজছি। আপনি যদি রাজি হয়ে যান, তা হলে আর বৃথা খোঁজাখুঁজির হয়রানির মধ্যে যাওয়ার মানে হয় না।”
“মন্ত্রী!” বলে নন্দ কবিরাজ হাঁ হয়ে রইলেন। বিনয়ী দিনু বলল, “মন্ত্রীদেরই এখন রবরবা। কবরেজি করে আর ক’ পয়সাই বা হয় আপনার! মন্ত্রীর বেতন ভাল, উপরি আছে, ক্ষমতাও কম নয়। তবে তাড়াহুড়োর কিছু নেই। মাথাটি ঠাণ্ডা রেখে দু’দিন ভাবুন। ভেবেই বলবেন।”
দিনু আর দাঁড়াল না। সরে পড়ল। পিছু-পিছু আসতে আসতে ঝিকু বলল, “এঃ, তুমি যে কবরেজমশাইকে মন্ত্রীর অ্যাপয়েন্টমেন্টটা দিয়েই ফেললে দিনুদাদা! তা আমার ব্যবস্থাটা কী হবে?”
“কেন, তুই হবি আমার কোটাল।”
“কোটাল! কোটাল মানে কী?”
“মানে কি আমিই জানি? শুনেছি রাজাদের একটা করে কোটাল থাকে, তাই বললাম। তা কোটালের কাজও খারাপ হওয়ার কথা নয়। বেতন আছে, উপরি আছে, ক্ষমতাও কম নয়।”
“রাজা তা হলে তুমি হচ্ছই?”
“ওরে, রাজা না হয়ে আমার উপায়ও নেই কিনা। আমার কোষ্ঠীতে যে রাজা হওয়ার যোগ আছে। ইচ্ছে না থাকলেও রাজা আমাকে হতেই হচ্ছে। রাজা হওয়ার ঝকমারি কি কম?”
“তুমি যে শশীবাবুর ভৃত্য ছিলে, আর চুরি করেছিলে বলে শশীবাবু যে তোমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, এ কথাটা কিন্তু আমাকে বলোনি কখনও।”
দিনু একটু হাসল। বলল, “দুঃখের কথা কি মনে রাখতে আছে। রে? ওসব ভুলে যাওয়াই ভাল। আমার জীবনটা দুঃখে-দুঃখে একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে আছে, বুঝলি? সেই যখন ছোট্ট ছিলুম ৪৪
তখন থেকেই বেঁটে বলে ছেলেরা আমার পেছনে লাগত। যখন-তখন মাথায় উঁটি কষাত। কারও সঙ্গে পারতুম না।”
“তারপর?”
“তারপর কত ঝঞ্ঝাট গেছে। শশীবাবুর বাড়িতে চাকরি পেয়ে প্রথম প্রথম খুব সুখ ছিল। ভারি ভালবাসতেন আমায়। একেবারে নিজের ছেলের মতো।”
“তা হলে তাড়াল কেন?”
“সেইটেই তো ভাবি। দোষও কিছু তেমন করিনি। ক্ষান্তদিদির একটা বালা সরিয়ে রেখেছিলুম, সেই হল অপরাধ।”
“চুরি করেছিলে?”
“ওসব চুরিটুরি কথাগুলো ফস করে মুখে আসে কেন তোর? আমার এখন একটা সামাজিক মান-মর্যাদা হতে যাচ্ছে। ওসব অসভ্য কথা খবরদার উচ্চারণ করবি না। ব্যাপারটা চুরির পর্যায়েও পড়ে না। নিতান্তই ঘরের ছেলে হিসেবে একটা জিনিস এধার থেকে নিয়ে ওধারে রেখেছিলুম। ওই বদমাশ হাতটা না থাকলে ধরাও পড়তুম না।”
“হাতটা যদি বদমাশই হবে, তা হলে সেটার জন্য এমন হন্যে হয়ে পড়েছ কেন?”
দিনু গম্ভীর হয়ে বলে, “তার কারণ আছে। শশীবাবু মস্ত আহাম্মক। তিনি হাতটা হাতে পেয়েও কাজে লাগাতে পারেননি। কেবল সৎ কাজ করতে লাগলেন। সৎ কাজের দাম কী বল! হাতটার মর্যাদাই উনি বুঝতে পারলেন না। আলাদিনের আশ্চর্য পিদিম যা, এও হল তাই। যা করতে বলা হবে, তাই করবে। শশীবাবু যদি হুকুম করতেন, যাও গিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভল্ট থেকে দু কোটি টাকা নিয়ে এসো, তা হলে হাত তাই করত। তাতে পাপও হত না। নিজে তো আর করছেন না, পাপটাপ যা হওয়ার তা ওই হাতের ওপরেই অশাবে। নরকে যেতে হয় তো হাতই যাবে। কথাটা আমি ঠারেঠোরে শশীবাবুকে বোঝানোর চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু আহাম্মকরা যদি ভাল কথা বুঝতেই পারবে, তা হলে আর তাদের আহাম্মক বলেছে কেন?”
“তুমি কি হাতটা দিয়ে চুরি-ডাকাতি করাবে নাকি?”
“ফের ‘চুরি’ কথাটা উচ্চারণ করলি! চুরির ব্যাপারই নয়। তোকে একটা কথা বুঝিয়ে বলছি, মন দিয়ে শোন। দুনিয়াটা ভগবানের, ঠিক তো?”
“তা বটে।”
“এই দুনিয়ায় গরিব-বড়লোক মিলে আমরা যারা আছি, সবাই তো ভগবানেরই সন্তান, না কি?”
“তাই তো মনে হয়।”
“আর দুনিয়ার যত টাকা-পয়সা, ধনদৌলত, এসবও হরেদরে ভগবানেরই। ঠিক কথা বলছি তো! ভুল বললে ধরিস।”
“ঠিকই বলছ।”
“তা হলে দ্যাখ, রাপের পাঁচ ছেলে যেমন বাপের সম্পত্তির সমান হিস্যাদার, আমরাও ঠিক তেমনই ভগবানের সব জিনিসেরই সমান হিন্যাদার। বুঝলি? ভুল বললে শুধরে দিস।”
“কথাটা তো ন্যায্যই মনে হচ্ছে।”
“তা হলেই দ্যাখ, ভগবানের দুনিয়ায় কিছু লোক লুটেপুটে খায়, কিছু লোক আঙুল চোষে, এরকমটা হওয়া কি ভাল?”
“মোটেই নয়।”
“তা হলে আমি যা করতে যাচ্ছি, সেটাই যা খারাপ হবে কেন? যাদের ফালতু টাকা আছে, তাদের কাছ থেকে খানিকটা নিয়ে গরিবকে দিলাম। তাতে বড়লোকটা একটু নামল, গরিবটা একটু উঠল। একটা বেশ সমান-সমান ভাব এসে গেল। তাই না?”
“খুব ঠিক।”
“তুই দেবী চৌধুরানী বা রবিন হুডের নাম শুনেছিস?”
“কস্মিনকালেও না। তারা কারা?”
“নমস্য ডাকাত। তাদের নাম শুনলে আজও কত সাধুপুরুষও মাথা নোওয়ায়। তা, তারা যা করেছে, তার চেয়ে আমি আর খারাপটা কী করব বল! দুনিয়ায় যে ভগবানের সন্তানদের প্রতি অবিচার চলছে, তার একটা বিহিত করতেই আমার জন্ম। আরও একটা কথা শুনে রাখ।”