- বইয়ের নামঃ কুঞ্জপুকুরের কাণ্ড
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. শশীদাদুর হাতটা
কুঞ্জপুকুরের কাণ্ড – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
শশীদাদুর হাতটা যতদিন ক্রিয়াশীল ছিল, ততদিন এলাকাটা ছিল শান্তির জায়গা। চোর, ডাকাত, গুণ্ডাদের উৎপাত ছিল না। কেউ কোনও অন্যায় কাজ করার আগে দু’বার ভাবত। আইনশৃঙ্খলার অবস্থা ছিল খুবই ভাল। সবাই বলত, কুঞ্জপুকুরের মতো এমন নিরাপদ জায়গা আর হয় না।
কিন্তু শশীদাদুর হাত ঝিমিয়ে পড়ার পর থেকেই কুঞ্জপুকুরের আশপাশে যেন পাজি বদমাশদের মাথাচাড়া দেওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সবই অবশ্য ছোটখাটো ঘটনা, আমল না দিলেও চলে। কিন্তু এগুলো হচ্ছে পূর্বলক্ষণ। চোর-বদমাশরা একটু বাজিয়ে দেখছে পরিস্থিতিটা। এই তো সেদিন হাফিজুল মিঞা হরিপুরের হাট থেকে সন্ধের পর ফিরছিল। রাম দত্তর বাঁশবনের ভেতর দিয়ে আসার সময় কে যেন তার মাথার চুবড়ি থেকে টুক করে ডালের পোঁটলাটা সরিয়ে ফেলল। আবার দিন-দুই পরেই হরিবল্লভ রায় বিকেলে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। বড় ঝিলের ধারে দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছেন, হঠাৎ একটা মুষকো মতো লোক কোথা থেকে এসে তাঁর হাতের রুপোর বাঁধানো লাঠিখানা কেড়ে নিয়ে হাওয়া।
সরকারবাড়ির ঘটনাটাও খারাপ। সেদিন মাঝরাতে সরকারবাড়ির একতলার জানলা ভেঙে চোর ঢুকেছিল। লোকজন উঠে পড়ায় বেশি কিছু নিতে পারেনি, দুটো কাঁসার থালার ওপর দিয়ে গেছে।
কিন্তু কথা হল, শশীদাদুর হাত যদি ক্রিয়াশীল থাকত, তা হলে এসব হতেই পারত না। কুঞ্জপুকুরের মোড়ল-মুরুব্বিরা এবং আশপাশের সাত গাঁয়ের লোক চিন্তায় পড়ে গেছে। ঘন-ঘন সবাই বৈঠকেও বসছে। নন্দ কবিরাজকেও ডাকা হয়েছে বৈঠকে। নন্দ কবিরাজ বলছে, “শশীখুড়োর বয়স এই একশো সাত পুরে একশো আট বছর চলছে। এত বয়সের মানুষ সম্পর্কে কোনও ভরসা দেওয়া যায় না। তবে আমি সাধ্যমতো চিকিৎসা করে যাচ্ছি। দেখা যাক কী হয়!”
শশীদাদু থাকেন একখানা খোলামেলা ঘরে। পাশেই মস্ত বাগান, হরেক ফুল, হরেক গাছ সেখানে। শশীদাদুর ঘরে মস্ত মস্ত জানলা। অনেক আলো-হাওয়া খেলে। জানলার পাশেই একটা মস্ত চৌকিতে শশীদাদু শুয়ে থাকেন সারাদিন। মস্ত চুল আর দাড়ি, সব সাদা ধবধব করছে। শশীদাদুর গায়ের রঙও খুব ফরসা, লম্বা শীর্ণ চেহারা। ক’দিন আগেও তিনি যুবকের মতো দ্রুতপায়ে এ-গাঁ ও-গাঁ ঘুরে বেড়াতেন। সকলের খোঁজখবর করতেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন হল, কোনও অসুখেই হোক, বা বার্ধক্যের জন্যই হোক, উনি একেবারে শয্যা নিয়েছেন। কারও সঙ্গে কথা বলেন না। সবসময়ে চোখ বোজা। ডাকলে সাড়া দেওয়া দূরের কথা, চোখ মেলে তাকান না পর্যন্ত। শশীদাদুর মেয়ে বিধবা ক্ষান্তমণিই তাঁকে আগলে রাখে।
শশীদাদু শয্যা নেওয়াতে সকলেরই মনখারাপ। বিশেষ করে গাঁয়ের ছেলেপুলেরা। শশীদাদু রোববারে চণ্ডীমণ্ডপে বাচ্চাদের
নিয়ে ভারি ভাল একটা আসর জমাতেন। তাতে গল্প, ম্যাজিক, ধাঁধা, কত কী হত! সব বন্ধ হয়ে আছে। আর শশীদাদুর সেই বিখ্যাত হাতখানাও বিছানার পাশে একটা টেবিলের ওপর পড়ে আছে চুপচাপ। নড়েও না, চড়েও না।
হাতটা দেখতে হাত-ভরা একটা দস্তানার মতো। সলিড জিনিস। সাইজেও বেশ বড়, সাধারণ মানুষের পাঞ্জার দেড়গুণ হবে। কবজির কাছটা কাটা। কাটা অংশের কোনও ফাঁকফোকর নেই। যেন রবারে তৈরি জিনিস। রঙখানা ধবধব করছে সাদা।
ইতিবৃত্তান্ত কেউ কিন্তু জানে না। শশীদাদু কখনও কিছু বলেন। হাতটা নিয়ে প্রশ্ন করলে মিটিমিটি হাসেন আর বলেন, “দুনিয়ায় কত আশ্চর্য ব্যাপার আছে।”
হাতটা নিয়ে গাঁয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। হরিবল্লভ রায় বলেন, “শশীখুড়ো ভবঘুরে লোক। সারা পৃথিবী চষে বেরিয়েছেন। জাহাজে, এরোপ্লেনে, রেলগাড়িতে, মোটরে, সাইকেলে আর পায়ে হেঁটে কোনও জায়গা বাকি রাখেননি। দুর্গম সব অঞ্চলে প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে ঘুরতেন। একবার আপস পাহাড়ে ওঠার সময় একজন পর্বতারোহীকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছিলেন। পর্বতারোহী এক সাহেব। পাহাড়ের একটা খাঁজ ধরে ঝুলছিল। শশীখুড়ো তার ডান হাতখানা শক্ত করে ধরে যখন টেনে তুলবার চেষ্টা করছিলেন তখন বুঝতে পারেননি যে, সাহেব আসলে অনেকক্ষণ আগেই ঠাণ্ডায় জমে মারা গেছে। হাতটা ঠাণ্ডায় জমে শক্ত হয়ে যাওয়ায় দেহটা পড়ে যায়নি। কিন্তু যেই শশীখুড়ো টেনে তুলতে গেলেন, তখনই টানাহ্যাঁচড়ায় হাতটা শরীর থেকে খসে এল। সাহেবও পড়ে গেল নিচে। তবে হয়েছিল কী, সাহেবের আত্মাটা আশপাশেই ঘুরঘুর করছিল। শরীরের একটা মায়া আছে তো, সহজে ছাড়তে চায় না। আত্মাটার খুব ইচ্ছে ছিল শরীরে আবার ঢুকে পড়ে। কিন্তু শরীরটা পাহাড় থেকে পড়ে যাওয়ায় আত্মাটা তখন বাধ্য হয়ে হাতটার মধ্যেই ঢুকে পড়ল।”
দিনু সরকার অবশ্য বলেন, “ওরে না, না। ও গল্প ঠিক নয়। শশীজ্যাঠার যৌবনে গায়ে ছিল পেল্লায় জোর। আমরাও দেখেছি, শশীজ্যাঠা একবার একটি বড় আমগাছ স্রেফ জাপটে ধরে টেনে উপড়ে ফেললেন। একবার তো কেঁকি তুলে সেইটে বনবন করে ঘোরাতে-ঘোরাতে একদল ডাকাতকে তাড়া করেছিলেন। তা হয়েছিল কী, সেবার আফ্রিকার জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে-বেড়াতে এক মস্ত গরিলার মুখে পড়ে গিয়েছিলেন। শশীজ্যাঠা তার সঙ্গে ঝগড়া কাজিয়ায় না গিয়ে বন্ধুত্ব পাতাতে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন, বললেন, মিস্টার গরিলা, হাউ আর ইউ? কিন্তু গরিলাটা ছিল ত্যাঁদড়। হ্যান্ডশেক করার ভান করে সে শশীজ্যাঠার হাত ধরে এমন হ্যাঁচকা টান মারল যে, শশীজ্যাঠা উলটে পড়লেন। তারপর আবার শশীজ্যাঠাকে হাত ধরে আর-একটা আছাড় মেরেছিল সে। শশীজ্যাঠার খুব রাগ হল। গরিলার এত সাহস! তিনিও তখন দিলেন হ্যাঁচকা টান। ব্যস, গরিলার হাত কবজি থেকে খসে শশীজ্যাঠার হাতে চলে এল, আর গরিলা ব্যাটা ‘বাপ রে, মা রে’ বলে চেঁচাতে-চেঁচাতে হাওয়া! শশীজ্যাঠা হাতটা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দেন। অনেকদিন বাদে গরিলাটা মারা যায়। তার আত্মাটা শশীজ্যাঠার কাছে ক্ষমা চাইতে আসে। তখন শশীজ্যাঠা আত্মাটাকে ওই হাতটার মধ্যে ভরে রাখেন।”