চড় খেয়ে বটেশ্বরের চোখে সরষেফুল নাচানাচি করছে, মাথার ভিতরে ঝিমঝিম শব্দ। এ তল্লাটে এমন বুকের পাটা কারও নেই যে, তার গায়ে হাত তোলে। তাই একটু সামলে উঠেই “তবে রে,” বলে বটেশ্বর সাধুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু একটা নিরেট দেওয়ালেই যেন ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে এল সে।
সাধু কাঁক করে তার ঘাড়টা ধরে ঠেলতে-ঠেলতে মাঠের উত্তর দিকে নিয়ে যেতে-যেতে বলল, “তোর এখনও অনেক শিক্ষা বাকি আছে দেখছি!”
বটেশ্বর বুঝল, তার এতকালের এত মেহনত, এত কসরত, এত ঘাম ঝরানো সবই বৃথা গিয়েছে। এত ঢেউ খেলানো পেশি, এত ল্যাটিসমাস বাইসেপ, কাফ মাসল, সিক্সপ্যাক নিয়েও এসব কী হচ্ছে? এ যে বাঘের মুখে নেংটি ইঁদুরের মতো দশা তার! সে চিচি করে লোকজন ডাকার চেষ্টা করছিল, কিন্তু পিছন থেকে সাধু হুড়ুম করে তার মাজায় হাঁটু দিয়ে এমন গুতো মারল যে, বটেশ্বরের বাক্য হরে গেল। হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, “ও মশাই, ও সাধুবাবা, এ কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায়? এসব কী হচ্ছে? এর ফল কিন্তু খুব খারাপ হবে!”
সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, নাডুবাবু মাঠে তার গোক খুঁজতে এসেছেন, কিন্তু বটেশ্বর তাঁকে হাত নেড়ে ডাকতেই তিনি সুট করে গোরুর আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন। ঘেসুড়ে রামদীনও তার দুর্দশা দেখে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। প্যালাবাবু শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরছিলেন, একেবারে মুখোমুখি দেখা। কোথায় সাধুটার পথ আটকাবি, ধমক চমক চেঁচামেচি করে লোক জোটাবি, তা নয়, একগাল হেসে গদগদ হয়ে বললেন, “সাধুর কাছে মন্তর নিলি বুঝি বটেশ্বর? বাঃ বাঃ, ধর্মকর্ম খুব ভাল জিনিস!” এই বলে চলে গেলেন।
লাঠিধারী নন্দরাম চৌকিদারকে দেখে একটু ভরসা হয়েছিল বটেশ্বরের। কিন্তু উলটে নন্দরাম ভারী ভক্তিভরে হাতজোড় করে “গোর লাগি সাধুবাবা,” বলে সাধুকে গদগদ হয়ে পেন্নাম করে পথ ছেড়ে দিল।
পায়েসপুরের উত্তরে প্রতাপগড়ের গহীন জঙ্গল। সেই জঙ্গল নিয়ে বিস্তর রোমহর্ষক গল্পও আছে। রাতে তো দূরের কথা, দিনেদুপুরেও বড় একটা কেউ জঙ্গলে ঢোকে না। সাধু বটেশ্বরকে নিয়ে সেই জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঘটনাটা চাউর হতে দেরি হল না। সন্ধেবেলাতেই চণ্ডীমণ্ডপে মেলা লোক জড়ো হয়ে গেল।
রাখোহরি কানে কম শোনে। তার ধারণা, বটেশ্বরকে বাঘে নিয়ে গিয়েছে। খুব চিন্তিত মুখে বলছিল, “কথা হল, বটেশ্বরকে ক’টা বাঘে খাবে? সাতটা বাঘের খোরাক যদি একটা বাঘে খায়, তা হলে কি বড্ড আইঢাই হবে না? কত মাংস বটেশ্বরের?”
নোয়াপাড়ার বজ্ৰবাহু ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বলল, “ওসব অলক্ষুনে কথা কেন দাদা? বাঘ নয়, বটেশ্বরকে এক সাধু নিয়ে গিয়েছে।”
গদাধর ঘনঘন মাথা নেড়ে বলল, “বাঘে নিলে আর খারাপ কী হত বলো! সাধুর যা বৃত্তান্ত শুনছি তাতে তো মনে হয়, বটেশ্বরকে হয় শবসাধনায় লাগাবে, নয়তো নরবলি দেবে কিংবা কেটেকুটে নরমাংস খাবে। আরে এই সাধুই তো নগেন সর্বাধিকারীর বাড়িতে কদিন আগে হামলা করেছিল, ওদের টমি কুকুরটা তাড়া করায় তেমন কিছু করতে পারেনি।”
নাডুবাবু ঘটনার সাক্ষী। তিনি রোগা মানুষ। উঠে দাঁড়িয়ে জমায়েত লোকজনের সামনে বললেন, “আহা, আমিই তো ছেলেধরাটার হাত থেকে বটেশ্বরকে উদ্ধার করতে পারতাম। কিন্তু এক হাতে গোরুর দড়িটা ধরা ছিল বলে হয়ে উঠল না। তবে একথা ঠিক যে, সেই বিভীষণ সাধুর হাতে পড়ে বড়ই নাকাল হচ্ছিল বটেশ্বর। ওর ভবিষ্যৎ বিশেষ উজ্জ্বল বলে মনে হচ্ছে না।”
প্যালাবাবু ভারী বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, “তা হলে তোমরা বলতে চাও যে, বটেশ্বরের বৈরাগ্য আসেনি? আমি তো ভেবেছিলুম সংসার-বৈরাগ্য আসায় বটেশ্বর সাধুর হাত ধরে সন্ন্যাসে যাচ্ছে! অপহরণ বলে বুঝতে পারলে কী আর সাধুব্যাটা পারত আমার হাত থেকে পালাতে?”
রামদীন মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বলল, “সাধুজি বটেশ্বরবাবুকে পাকড়ে নিয়ে যাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু আমি শোচলাম কী, বটেশ্বরবাবু দুই মুক্কা মেরে সাধুকে জমি ধরিয়ে দিবেন। আমি দুবলা মানুষ, জিন্দেগিতে কখনও মারপিট করিনি, উসি লিয়ে আমি আঁখে ঘুরিয়ে নিলাম।”
খগেন তপাদার নন্দরামের দিকে চেয়ে বললেন, “তোর হাতে তো লাঠি ছিল, সাধুটাকে ঘা কতক দিতে পারলি না?”
নন্দরাম জিভ কেটে দু’হাত দিয়ে কান ছুঁয়ে নিয়ে বলল, “ছিঃ ছিঃ, ওকথা বলবেন না। সাধু-মহাত্মাদের গায়ে হাত তুলে কী সাতজন্ম নরকে পচব মশাই? আর খুব তেজালো সাধু মশাই! চোখ দুখানা ধকধক করে জ্বলছিল, আর কী দশাসই চেহারা!”
বটেশ্বরের বাবা সর্বেশ্বর মুখ কালো করে বসে ছিলেন। ফোঁত করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “এখন মুক্তিপণের অত টাকা আমি পাব কোথায়? আপনারা পাঁচ-দশ টাকা করে কালেকশন না দিলে সাধু যে ছেলেটাকে মেরে ফেলবে!”
খগেন অবাক হয়ে বললেন, “মুক্তিপণ কি চাওয়া হয়েছে?”
সর্বেশ্বর বলল, “এখনও চায়নি বটে, কিন্তু চাইবে। আগে থেকে প্রস্তুত না থাকলেই বিপদ। আমি বড় দেখে একটা ধামা নিয়েই এসেছি। আপনারা উদারহস্তে টাকা ফেলতে শুরু করে দিন। এখন থেকে রোজই বাড়ি-বাড়ি ঘুরে চাদা তোলা হবে।”
সর্বেশ্বরের এই ঘোষণা শুনে একজন দু’জন করে লোক কেটে পড়তে লাগল। এবং চণ্ডীমণ্ডপ ফাঁকা হয়ে যেতে সময় লাগল না।
৩. পরদিন সকালবেলা কেপুবাবু
পরদিন সকালবেলা কেপুবাবু খুবই সন্তর্পণে রাধাগোবিন্দর বাইরের ঘরে ঢুকে একটু গলাখাকারি দিলেন। আত্মজীবনী রচনায় মগ্ন রাধাগোবিন্দ আবশ্য সেই শব্দ শুনতে পেলেন না। কেপুবাবু ফের একটু জোরে গলাখাকারি দিয়ে মোলায়েম গলায় ডাকলেন, “রাধাদা!”